বিল্লাহ মামুন ভাই কাপ্তাই লেক ঘুরে দেখার জন্য একটা হাউজ বোটে দুইটা সীট ফাঁকা আছে বলে পোস্ট দিল। উনি স্বপ্নযাত্রা ট্রাভেল গ্রুপটা ম্যানেজ করে। দেখা মাত্রই আমি বললাম ভাই, আমরা ইনশাহ আল্লাহ যাবো। উনি বলল তাহলে পোস্ট আপডেট করে দিচ্ছি।
উনি মূলত অন্য একটা গ্রুপের জন্য এই ট্যুরটা আয়োজন করেন। এক কাপল না যেতে পারার কারণে ফাঁকা হয় আর আমাদেরও যাওয়ার সুযোগ হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা চার তারিখে ঢাকা থেকে রওনা দেই। রাত সাড়ে দশটার দিকে বাস ছিল। ফকিরাপুল থেকে বাস। বৃহস্পতিবার বলে একটু আগেই বাসা থেকে বের হই। জ্যামে পড়লে দেরি হয়ে যেতে পারে ভেবে। ফকিরাপুল গিয়ে রাতের খাবার খেয়ে নেই আমরা। খেয়ে দেয়ে চা খাচ্ছিলাম। মামুন ভাই তখন ফোন দিয়ে বলল যে বাস চলে আসছে, আমরা কোথায়। বললাম পাশেই আছি। চা শেষ করে বাসে উঠে পড়ি। বাসে উঠে দেখি সবাই পরিচিত। রমিন ভাই & ভাবি, মিশুক ভাই সহ অন্যরা। উনাদের সাথে এর আগেও ঘুরতে গিয়েছি, স্বপ্নযাত্রার সাথেই।
যে হাউজ বোটে করে আমরা ভ্রমণ করব তার নাম মাউরুম। ছোট খাটো সুন্দর একটা বোট। মোট চারটা রুম। ৮-১০ জন এই বোটে করে ট্যুর দিতে পারবে সহজে। আমরা ছিলাম বারো জন। মিশুক ভাই টেন্ট নিয়ে এসেছে। দুইজন ডেকে টেন্ট সেট করে ঘুমিয়েছিল।
শুক্রবার
সকাল ৭টার মধ্যেই আমরা রাঙ্গামাটি পৌঁছাই। বাস থেকে যেখানে নামি, সেখানেই বোটটা নোঙ্গর করা ছিল। বাস থেকে নেমে আমরা আমাদের হাউজবোটে উঠে পড়ি। যে যার রুমে ঢুকে ফ্রেস হয়ে নেই। এর কিছুক্ষণ পর আমাদের নাস্তা পরিবেশন করে। পরোটা, ডাল, ভাজি, ডিম, চা ইত্যাদি। নাস্তা খেয়ে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নেই। বাসে ঠিক মত ঘুম হয়নি।
ঘুম থেকে উঠে দেখি হাউজবোট রওনা শুরু করেছে। কাপ্তাই লেক অসাধারণ সুন্দর একটা যায়গা। পানির মধ্যে ছোট ছোট দ্বীপের মত টিলা। পানি গুলো অনেক পরিষ্কার, নীল পানি। কিছুক্ষণ ছবি তুললাম, ভিডিও করলাম। এর মধ্যে আমাদের কলা, বিস্কিট পরিবেশন করল। এছাড়া আনলিমিটেড চা, কফির ব্যবস্থা ছিল। নিজ হাতে চা তৈরি করে খেতে খেতে কাপ্তাই লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলাম।
আমাদের একটা ঝর্ণায় নিয়ে গিয়েছিল। ঝর্ণায় গিয়ে দেখি পানি খুব একটা নেই। এছাড়া প্রচুর পর্যটক। ঝর্ণায় নামতে ইচ্ছে করেনি। ঐখানে একজন নৌকায় করে ডাব বিক্রি করছিল। উনার থেকে ডাব কিনে খেলাম। ডাবের কি যে দাম! ঢাকায় তো ১০০টাকার নিচের এখন ডাব পাওয়া যায় না। সেখানেও কম না। ৭০ টাকা করে। আমাদের গোসল করতে খুব ইচ্ছে করছিল। তবে এত মানুষের মধ্যে না। সবাই মিলে সীদ্ধান্ত নেওয়া হলো অন্য কোথাও যাবো। বোট যে ম্যানেজ করে, সে আমাদের অপর পাশে একটা যায়গায় নিয়ে গেলো। লোকাল মানুষদের গোসল করার একটা ঘাট ছিল, সেখানে। তো আমরা নৌকা থেকে নেমে গোসল করলাম। লাইফ জ্যাকেট ছিল। অনেকক্ষণ পানিতে ছিলাম। পানিতে থাকতে ভালোই লাগে। শহরের সুইমিং ফুল খুব একটা পছন্দের না। কারণ তো জানাই আছে সবার। এ জন্য, পুকুর, সমুদ্র বা লেক পেলে পানিতে নামতে ছাড়ি না। এসব জায়গায় মন খুলে সাঁতার কাটা যায়।
যেখানে নোঙ্গর ফেলছে, সেখানে একটা বট গাছ ছিল। গোসল করার পর দেখি খাবার পরিবেশন করেছে। দারুণ সব আইটেম। ব্যাম্বো চিকেন, ছোট মাছ ভাজি, মাশরুম কারি, শাক, আলু ভর্তা, সবজি, ডাল ইত্যাদি আইটেম ছিল। খাবার এত বেশি মজা হয়েছে বলে বুঝানোর মত না। বাবুর্চিটা অসাধারণ রান্না করে বুঝলাম। ঢাকা থাকতে একটু কম খাওয়ার চেষ্টা করতাম, ডায়েট কন্ট্রোল হিসেবে। এত মজার খাবার দেখে সব ভুলে গেলাম। ইচ্ছে মত খেয়ে ডোল হওয়ার মত অবস্থা।
খাওয়া দাওয়া করে কফি তৈরি করে বসলাম ডেকে। এরপর আমাদের অন্য এক জায়গায় নিয়ে গেলো। যায়গাটা ছিল Bargee Lake Valley এর একটা অংশ। ঐখানে কায়াকিং করা যায়, সুইমিং করা যায়। এছাড়া অসাধারণ একটা রেস্টুরেন্ট আছে Bargee Resturant নামে। যারা রাঙ্গামাটি থাকেন, তারা এখানে ঘুরতে আসতে পারেন। ভালো লাগবে।
সন্ধ্যার দিকে আমাদের আবার নাস্তা দিল। দুই প্রকারের পিঠা। একটা নারিকেলের পিঠা ছিল। নারিকেলের পিঠাটা অসাধারণ হয়েছে। দুপুরে খাওয়ার পর পেটে খুব একটা যায়গা খালি ছিল না। এরপরও দুই রকম পিঠা থেকে দুইটা ট্রাই করেছি। সন্ধ্যার দিকে নৌকা থেকে নেমে Bargee এরিয়া একটু ঘুরে দেখলাম। কিছুক্ষণ ঘুরে বোটে ফিরে এলাম। পরিবেশ এত বেশি রিলাক্সিং যে ঘুম পাচ্ছিল। কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিলাম।
ঘুম থেকে উঠে দেখি আমাদের জন্য বার-বি-কিউ তৈরি। চিকেন রেশমি কাবাব তৈরি করেছে আমাদের জন্য। সাথে ছিল পরোটা, জলপাই চাটনি, সালাদ, কোক। খাবার আগের মতই দারুণ। স্পেশালি জলপাই চাটনিটা। ঐটা বোটেই তৈরি করেছিল। কি যে দারুণ লেগেছে ঐ চাটনিটা।
ঢাকার বাহিরে গেলে রাতের আকাশের তারা স্পষ্ট ভাবে দেখা যায়। আকাশের দিকে তাকালেই মন ভালো হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা। পুরো আকাশে অনেক গুলো তারা। আবহাওয়া না গরম, না ঠাণ্ডা। অসাধারণ লাগছিল সব। দিনে কয়েকবার ন্যাপ নেওয়াতে আর ঘুম আসছিল না। কিছুক্ষণ হাঁটা হাঁটি করে কিছুক্ষণ আকাশ দেখে কিছুক্ষণ গল্প করে কাটিয়ে দিলাম।
শনিবার
পরের দিন ভোরে উঠে গেলাম সূর্যদয় দেখার জন্য। বোটের ছাদ থেকে চার পাশের সুন্দর ভিউ দেখা যায়। পূর্বদিকে হালকা মেঘ থাকায় সূর্য উঁকি দিতে কিছুটা সময় লেগেছে। দেখতে সুন্দরই লাগল। কিছু ছবি তুলে ফিরে গেলাম কেবিনে। ঘুমিয়ে নিলাম আরো কিছুক্ষণ। আটটার দিকে মামুন ভাই নাস্তা খাওয়ার জন্য ডাকল। ফ্রেস হয়ে নাস্তা খেতে বসলাম। ভুনা খিচুড়ি, ডিম, জলপাই চাটনি। খিচুড়ির মধ্যে মাংস না থাকলে তা আমার কাছে খিচুড়ি মনে হয় না। যদিও খেতে খারাপ লাগেনি। বিশেষ করে জলপাই আচার দিয়ে।
খাওয়া দাওয়া করে কায়াকিং করতে গেলাম। যেখানে আমাদের নৌকা নোঙ্গর ফেলছে, বারগিতে। তারা কায়াকিং বোট ভাড়া দেয়। দুই জনের জন্য ৩০০ টাকা প্রতি ঘণ্টা। ৩ জনের জন্য ৪০০ টাকা। লেকের শান্ত পানিতে কায়াকিং করতে কি যে ভালো লেগেছে। আমরা অনেক দূর গিয়েছি কায়াকিং করতে করতে। নিমিষেই এক ঘণ্টা পার হয়ে গেলো। ছবি তুলে, ভিডিও করে ফিরে এলাম নৌকায়। আবার একটু ঘুমিয়ে নিলাম। আপনারা হয়তো কনফিউজড, যে ঘুরতে গিয়েছি নাকি ঘুমাতে গিয়েছি সেখানে। আসলে এত রিলাক্সিং ট্যুর, কি আর করব। এক ঘণ্টার মত ন্যাপ নিয়ে উঠলাম আবার। এবার হচ্ছে গোসল করার সময়। নৌকার ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নামলাম লেকের পানিতে। এরপর কিছুক্ষণ ভেসে থেকে, কিছুক্ষণ সাঁতার কেটে পার করে দিলাম। পানি এত পরিষ্কার। দারুণ লাগছিল সাঁতার কাটতে।
গোসল করা শেষে ফ্রেস হয়ে নিলাম। ততক্ষণে দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গিয়েছে। আজকের আইটেম ছিল আইড় মাছের ঝোল, মাছ দিয়ে লাউ, লাউ চিংড়ি, ভর্তা ইত্যাদি। ঐ পরিবেশে এই খাবার গুলো অমৃতের মত লাগছিল।
খাওয়া দাওয়া শেষে আমরা রওনা দিলাম ঝুলন্ত ব্রিজ দেখতে। সেখানে কিছুক্ষণ ছিলাম। ব্রিজের পাশে নৌকায় করে পেঁপে, আনারস ইত্যাদি বিক্রি করছিল। আমরা আনারস এবং পেঁপে কিনে নিলাম। এরপর নৌকায় বসে খেয়ে রওনা দিলাম পলওয়েল পার্কের উদ্দেশ্যে। এই যায়গাটাও সুন্দর। তবে ক্রাউডেড। অনেক মানুষ এখানে ঘুরতে আসে। রাস্তা দিয়ে আসা যায়, তাই। সন্ধ্যা পর্যন্ত সেখানে ছিলাম। তারপর রওনা দিলাম আমাদের শেষ গন্তব্যে। যেখান থেকে শুরু করেছি, সেখানে।
দুই দিন নৌকাতে থেকে কেমন মায়া জন্মে গেছে। নামতে ইচ্ছে করছিল না। কি আর করার। নামতে হলো। এদিক দিয়ে ধর্মঘট চলছে। ডিজেল, কেরোসিনের প্রাইস বাড়ানোর কারণে বাস-ট্রাক ধর্মঘট চলছিল। এর আগে বান্দরবান ট্যুরেও একই সমস্যা হয়েছে। বিল্লাহ মামুন ভাই একটা Hi-Ace ম্যানেজ করল। আমরা উঠে পড়লাম, রওনা দিলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে। তখন সন্ধ্যা ৬টার মত। গাড়ি চলাচল বন্ধের কারণে হাইওয়ের বেশির ভাগ রেস্টুরেন্টও বন্ধ ছিল। কুমিল্লা এসে আমরা হাইওয়ে ইনে বসে রাতের খাবার খেলাম। ঢাকায় প্রায় রাতের দুইটার দিকে পৌঁছাই। আমাদের ড্রাইভার সম্ভবত ঈদের মত একটানা ভাড়া মারতেছিল। বুঝলাম উনার ড্রাইভ করতে কষ্ট হচ্ছে। পথে মাঝে মাঝে দাঁড় করিয়ে চা খাইয়ে নিয়েছি। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া যে আমরা সুস্থ ভাবে বাসায় পৌঁছাতে পেরেছি।
These pictures are nice, created by Allah. So we should grateful to Him.
খুব সুন্দর