বান্দরবান ঘুরাঘুরির দুইদিন

রমজানে বান্দরবান যাওয়ার প্ল্যান করছিলাম। যাওয়ার কথা ছিল সেকন্দারের সাথে। বান্দরবান আমিনুল ভাই আছেন। উনাকে ফোন দিলাম, উনি বললেন সব কিছু নাকি বন্ধ। যাওয়ার প্ল্যান ক্যানসেল্ড।

এরপর কয়েক দিন আগে আবার প্ল্যান করলাম। এবারও সেকান্দারের সাথে। প্ল্যান করার পর রুবেল বলল চলো কোথাও থেকে ঘুরে আসি। আমি বললাম বান্দরবান চলো। সে তার হেডকোয়ার্টারের্টে যোগাযোগ করল। বিল পাশ হলো। আমরা কোথায় যাবো, কোথায় থাকব এসব প্ল্যান করছিলাম। আমিনুল ভাই বলল ইকোসেন্স নামে একটা রিসোর্ট রয়েছে, ঐখানে থাকতে পারি।

সেকান্দার বলল বিশেষ কারণে যেতে পারবে না। যার সাথে প্ল্যান করলাম, সেই যাবে না। ট্যুরের আগের দিন রাতে দুই একটা বন্ধু যেমন বলে ট্যুরে যেতে পারবে না, তেমন ফীল হচ্ছিল। আমার সেলফ ড্রাইভ করে যাওয়ার প্ল্যান ছিল। রুবেলের হেডকোয়ার্টার এবং আমার হেডকোয়ার্টার থেকে অনুমতি পাওয়া যায়নি। কি আর করা, বাস টিকেট কেটে নিলো রুবেল। চার জনের জন্য আটটা সিট। কভিড ইফেক্ট।

বাসে উঠার কথা ছিল এয়ারপোর্ট থেকে। বাসা থেকে রওনাও দিলাম। রুবেল কল দিয়ে বলল এয়ারপোর্টে নাকি বাস দাঁড়াতে পারছে না। খিলক্ষেত থেকে উঠতে হবে। ততক্ষণে আমরা খিলক্ষেত পৌঁছে গেছি। হুট করে উবার থেকে নেমে গেলাম। বেচারা পছন্দ করেনি। আমি নিজেও করতাম না। বাস আসল, আমরা উঠে পড়লাম।

বাস ছিল সেন্টমার্টিন হুন্দাই, রবি এক্সপ্রেস । যথেষ্ট ভালো গাড়ি। ভেতরে স্মেলও ছিল না। কুমিল্লা পার হওয়ার পর সম্ভবত বাসের চাকা একটা নষ্ট হয়েছে। ওরা ঠিক করল। আমি ঘুমে ছিলাম, আমার হুস ছিল না। আমি এতটুকু জেনেছি যে বাস থেমে আছে।

সকাল আটটায় আমরা বান্দরবান পৌঁছাই। আমরা নামি Holiday Inn Resort এর সামনে। ইকোসেন্স একই মালিকানার। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আমাদের সেখান থেকে ইকোসেন্সে পৌঁছিয়ে দেয়।

ইকোসেন্স রিসোর্টটা সুন্দর। নির্মাণাধীন। বিশাল এরিয়া নিয়ে ছোট ছোট কটেজ। কটেজ গুলোও ইকো ফ্রেন্ডলি। বাঁশ, কাঠ দিয়ে তৈরি। ফ্লোরের উপর আবার শীতল পাটি। সুন্দর ডিজাইন।

রিসোর্টে পৌঁছে আমরা নাস্তা করে নেই। আমিনুল ভাই আমাদের জানালো কোথায় কোথায় ঘুরতে পারি। উনি বলল সাঙ্গুতে নৌকা ভ্রমণে যেতে পারি। কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে রওনা দিলাম। রুবেলরা টায়ার্ড ছিল। ওরা রেস্ট নিচ্ছিল। আমরা দুইজন রওনা দিলাম। আমিনুল ভাই কথা বলে রেখেছে ঐখানকার নৌকার মাঝির সাথে। আমরা উঠে পড়লাম নৌকায়। স্রোতের বিপরীতে নৌকা চলতে থাকল।

সাঙ্গুতে এই ধরনের নৌকা দিয়ে আমরা ঘুরছিলাম

ওয়েদার খুবি সুন্দর ছিল। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। আমরা যাচ্ছিলাম একটা ঝর্ণাতে। তারাছা বাজারের একটু পর এই ঝর্ণাটি। ঝর্ণার কাছা কাছি যাওয়ার পর ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। নৌকায় দুইটা ছাতা ছিল। ছাতা মাথায় দিয়েও লাভ হচ্ছিল না। ঝুম বৃষ্টিতে ঝর্ণা উপভোগ করলাম কিছুক্ষণ। এরপর ফেরার জন্য রওনা দিলাম।

তারাছা বাজারের পাশের ঝর্ণাটি

ফেরার পথে তারাছা বাজার নামলাম। মাঝি বার বার জিজ্ঞেস করছিল তারাছা বাজার নামব কিনা। ভাবলাম কি আছে দেখি। বৃষ্টির কারণে অনেক বেশি কাঁদা হয়ে ছিল। নামতে গিয়ে জুতা কাঁদাতে ঢুকে গিয়েছে। পরে জুতা নৌকায় রেখে খালি পায়েই রওনা দিলাম। বাজারে গিয়ে হতাশ হলাম। দুই তিনটা চায়ের দোকান ছাড়া আর কিছু নেই। ঐখান থেকে গরম গরম সিঙ্গারা নিয়ে নৌকায় ফিরলাম।

আমিনুল ভাই বলছিল যদি ট্র্যাডিশনাল কোন খাবার খাই, যেন রিখ্যাইং রেস্টুরেন্টে যাই। কিছু খেতে হলে অগ্রিম অর্ডার দিতে হবে। অর্ডার দেওয়ার পর তৈরি করে দিবে। ব্যাম্বো চিকেন, শুটকির ভর্তা, ডাল ইত্যাদি নিয়ে রিসোর্টে ফিরলাম। খাওয়া দাওয়া করতে করতে বিকেল চারটা। আর কোথাও ঘুরতে যাওয়ার শক্তি ছিল না। বাকি সময় ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিলাম। রাতের খাবার রিসোর্টেই খেলাম। রুবেলে অর্ডার দিয়ে রেখেছিল। মাছ, মুরগি, ভর্তা ইত্যাদি। খাওয়া দাওয়া করে আবার ঘুম।

রাতে আমিনুল ভাই ফোন দিয়ে বলল পরের দিন চাইলে শৈল প্রপাত বা রুপালি ঝর্ণাতে যেতে পারি। ঘুম থেকে উঠে ফ্রেস হয়ে নাস্তা করে নিলাম। এরপর রওনা দিলাম শৈল প্রপাতের উদ্দেশ্যে। আগের দিন যে CNG তে করে নৌকার ঘাটে গিয়েছি, উনার নাম্বার রেখে দিয়েছিলাম। ফোন করার পর চলে এসেছে। শৈল প্রপাত যাওয়ার পথে পুলিশের একটা চেক পোস্ট রয়েছে। ঐখান থেকে সাঙ্গু নদীর অসাধারণ একটা ভিউ পাওয়া যায়। আমরা থেমে ছবি তুললাম।

সাঙ্গু নদী

শৈল প্রপাত যায়গাটা সুন্দর। সুন্দর একটা ঝর্ণা রয়েছে। শীতকালে সম্ভবত এই ঝর্ণাতে পানি থাকে না। এখন বর্ষাকাল হওয়াতে যথেষ্ট পানি ছিল। দেখতেও সুন্দর দেখাচ্ছিল। তার উপর কোন পর্যটক না থাকায় সুন্দর ভাবে আমরা জায়গাটা উপভোগ করলাম। ছবি তুললাম। ঝর্ণার অপর পাশে সুন্দর বসার জায়গা রয়েছে। ঐখানে গিয়ে কিছুক্ষণ বসলাম।

শৈল প্রপাতের ঝর্ণা

শৈল প্রপাত – উপর থেকে

পাহাড়ের উপর উঠতে নামতে যথেষ্ট টায়ার্ড হয়ে গেলাম। এখানে দোকান গুলোতে আনারস বিক্রি করছিল। দাম ঢাকা থেকে বেশি। একটা আনারস চায় ১০০ টাকা। যদিও সাইজে একটু বড়। আনারস কেটে কাসুন্দি, লবণ, এবং লেবু মেখে দিল। দারুণ লাগল খেতে। এই প্রথম দেখলাম আনারসের সাথে লেবু দিতে। লেবু দেওয়াতে এক্সট্রা একটা স্মেল আসছিল।

শৈল প্রপাত থেকে রওনা দিলাম রুপালি ঝর্ণার দিকে। দুইটা বান্দরবানের দুই দিকে। পথে বাস স্ট্যান্ডে নামলাম। আগের রাতেই নিউজ পেলাম বাস আবার বন্ধ করে দিয়েছে। এরপরও খোঁজ নেওয়ার জন্য যাওয়া। বলল বন্ধ। যাওয়ার উপায় হচ্ছে প্রাইভেট কার। বাস কাউন্টারের উনার থেকে নাম্বার নিয়ে একজনের সাথে কথা বললাম। ১৪ হাজার টাকা চাচ্ছিল। চট্রগ্রাম থেকে বিমানের টিকেট দেখলাম আরো কম আসে চার জনের জন্য। বিমানের টিকেট কেটে নিলাম ঐখানে বসেই, পরে আবার যদি বেড়ে যায়।

রুপালি ঝর্ণায় যাওয়া পথে আমিনুল ভাই এর অফিস। উনার সাথে দেখা করলাম। দুপুরের খাবারের জন্য পর্যটন মোটেলের রেস্টুরেন্টে খাবার অর্ডার দিয়ে দিলেন। রান্না করতে এক ঘণ্টার মত সময় লাগবে। আমরা চলে গেলাম রুপালি ঝর্ণা দেখতে। পর্যটক খুব একটা নেই। একদল ছেলে এসেছে বাইকে করে। ওরা গোসল করতেছিল। তাদের যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করছিলাম আমরা। যেন সুন্দর ছবি তুলতে পারি।

রুপালি ঝর্ণা

আমরা ঘুরাঘুরি করে এসে দুপুরের খাবার খেলাম। তখন যদিও বিকেল চারটা। গরম গরম খাবার খেতে দারুণ লাগছিল। পলাউ, মুরগি, মাছ ভাজি, বেগুণ ভাজি, ডাল এসব ছিল। খাবার খাওয়ার সময় কেমন মেহেমান মেহেমান ফীল হচ্ছিল। সাধারণ কোন বাড়িতে বেড়াতে গেলে যে ভাবে পরিবেশন করা হয়, ঠিক তেমন পরিবেশন ছিল। বিল দিয়ে গিয়ে দেখলাম স্বাভাবিকের থেকে একটু বেশি বিল করল। আমাদের জন্য একটা চিকেন রান্না করেছে। চার জনের জন্য ৩০০*৪ মানে ১২০০ টাকা রেখেছে শুধু চিকেনের জন্য। ঢাকার কোন ভালো রেস্টুরেন্টের সাথে তুলনা করলেও মনে হচ্ছিল বেশি।

খাওয়া দাওয়া করে নীলাচলের দিকে গেলাম। গিয়ে CNG ওয়ালাকে বিদায় দিলাম। উনি সারাদিনের জন্য মাত্র ১৫০০ টাকা চেয়েছে। বলল ১২০০টাকা হচ্ছে ঘুরাঘুরির জন্য, আর ৩০০ টাকা হচ্ছে অপেক্ষা করার জন্য। এমন ভদ্র CNG ড্রাইভার আমি এর আগে দেখি নাই। আমাদের রিসোর্টের পাশেই নীলাচল। নীলাচলও বন্ধ। এরপরও চারপাশে ঘুরার যায়গা রয়েছে। কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করে হেঁটেই রিসোর্টে ফিরলাম।

কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে সন্ধ্যার পর বান্দরবান গেলাম। মার্কেটে গিয়ে বার্মিজ কিছু জিনিস পত্র কিনলাম। এরপর গেলাম Holiday Inn Resort এ। আমিনুল ভাই ডিনারের দাওয়াত দিয়েছে। উনার ওয়াইফও আসছিল। খাওয়া দাওয়ার পর আমরা মালাই চা খাওয়ার জন্য একটা দোকানে গেলাম। দোকান ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অন্য দোকান থেকে চা খেয়ে নিলাম। এরপর উনাদের থেকে বিদায় নিয়ে রিসোর্টে ফিরলাম।

চট্রগ্রাম থেকে ঢাকায় যাওয়ার ফ্লাইট হচ্ছে বিকেল 3.40 এ। আমরা সকালে রওনা দিলাম চট্রগ্রামে। বাসে করে। চট্রগ্রাম পৌঁছাতে পৌঁছাতে সাড়ে এগারোটা। রুবেলের পরিচিত একজন (Alim Haider) দাওয়াত দিল মেজ্জান খাওয়ার। বারকোড ফুড জাংশনের মেজ্জানে খেলাম আমরা। এরপর রওনা দিলাম এয়ারপোর্টের দিকে।

এয়ারপোর্ট হচ্ছে ওয়েটিং এর যায়গা। আমাদের একটু দেরি হলে সমস্যা। কিন্তু তাদের দেরি হলে সমস্যা নেই। সম্ভবত দুনিয়ার সবচেয়ে কষ্টের কাজ হচ্ছে অপেক্ষা করা! 3.40 এর যায়গায় সাড়ে চারটার দিকে বিমান ছাড়ে। বিমানের উপর থেকে চট্রগ্রাম বন্দর অসাধারণ সুন্দর লাগে। পাঁচটার দিকে ঢাকায় নামি। আলহামদুলিল্লাহ্‌, আরেকটা সুন্দর ট্যুর দিয়ে বাসায় ফিরি।

বিমান থেকে চট্রগ্রাম বন্দর

Leave a Reply