সাইন্স ফিকশন – স্টেশন অরিয়ন-৯

আজ আনিকার সাথে দেখা করার কথা। কারণ আজ ওর জন্মদিন। তাই আগে থেকেই বলাছিল আমরা দু জনে এক সাথে বের হয়ে সারাদিন ঘুরবো। মন যেখানে চায় সেখানেই চলে যাবো। সমুদ্র সৈকতে গিয়ে একসাথে গোসল করব।

কিন্তু আমি যেতে পারি নি। কারণ গতরাতের একটি খবর শুনে আমার মাথা সব উলট পালট হয়ে গেছে। পৃথিবীর তৃতীয় মহাকাশ স্টেশন অরিয়ন-৯ তার কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছে। যা হচ্ছে সবচেয়ে বড় মহাকাশ স্টেশন এবং সবচেয়ে দরকারি। স্টেশনটি বিচ্যুত হলে কোন বিশেষ ক্ষতি হত না আর্থিক ক্ষতি ছাড়া, নতুন আরেকটা স্টেশন বসানো যেতো। সমস্যা হচ্ছে অরিয়ন-৯ এখন পৃথিবীর দিকে পড়ছে।  যার ফলাফল হবে ভয়াবহ। কারণ অরিয়ন-৯ মহাকাশ স্টেশনটি পুরোটাই পারমানবিক শক্তির সাহায্যে চলে। আছে বিশাল বিশাল  ৫টি পারমানবিক চুল্লি। পৃথিবীর বুকে  স্টেশনটি পড়লেই  সে গুলো বিস্পরিত হয়ে পুরো পৃথিবীর অর্ধেককে ধংশ করে দিবে। আর বাকি অর্ধেক ধংশ হবে তেজস্ক্রিয়তার শিকার হয়ে।

আমার পরিচয় এখন হয়তো জানতে চাইবেন, কেন আমি যেতে পারি নি, বা আমার সাথে অরিয়ন-৯ এর সম্পর্ক কি, তাই না? আমি ড. কলিন্স। একজন ভবঘুরে মহাকাশ বিজ্ঞানী।  অরিয়ন-৯ এর পুরো দায়িত্ব আমার উপর ছিল। কিন্তু মহাকাশে আমার ভালো লাগে না বলেই পৃথিবীর বুকে আমি ফিরে আসছি। আরেকটি কারণ হল আনিকা, তাকে হয়তো অনেক ভালবাসি বলেই তার থেকে দূরে থাকা পছন্দ করি না। আমি ফিরে আসবো শুনে এডমিনিস্ট্রেশন প্যানেলের সবাই আমার উপর রেগে গেলো, তারা আমার দায়িত্ত্বে অন্য কাউকে দিয়ে দিবে বলে হুমকি দিল। আমি সুযোগ পেয়ে চাকরি ছেড়ে চলে আসলাম। তাই বলে আমার হাতে গড়া অরিয়ন-৯ কে আমি ভুলতে পারি নি। নিয়মিত খবর রাখতাম। তাই অরিয়ন-৯ এর ধংশ হবে শুনে নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারি নি। ভুলে গেলাম আনিকার কথা । চলে গেলাম আমার ব্যক্তিগত গবেষণা গারে। সংগ্রহ করলাম অরিয়ন-৯ এর বর্তমান সকল তথ্য। আমি চাকরি ছেড়ে চলে আসার পর সবাই খুব হতাশ হলো। আমার নিজের ও খুব খারাপ লাগছে ঐ সময়, কিন্তু একগেয়েমী লাগে বলেই চলে আসতে বাধ্য হলাম। তাই তারা বলল যখন ইচ্ছে আমি যেন আবার যোগ দি অরিয়ন-৯ এর কাজে। আমার পদটা এখন ও শূন্য। কাউকে এখনো ও ঐ পদে নিয়োগ দেওয়া হয় নি। তাই আমি যেকোনো সময় যেকোনো তথ্যের প্রবেশাধিকার পেতে পারি। তাছাড়া আগে খেয়ালি ভাবে আমার গবেষণাগারের সাথে অরিয়ন-৯ একটা যোগাযোগ তৈরি করে রাখছিলাম, তা আজ আমার অনেক কাজে লাগে।

আমাদের বাড়ির নিচে বিশেষ ভাবে তৈরি করা হয়েছে আমার গবেষণাগারটি। আর্কিটেকচার সাথে আমি নিজে আলোচনা করে ডিজাইন করলাম যেন গবেশনাগেরর যেকোনো বিস্পরনে বাড়ির বা কারো কোন ক্ষতি না হয়। তাই গবেষণাগারটি তৈরি করা হয়েছে মাটির নিচে।  আমি খবরটি শুনে চলে গেলাম গবেশনাগারে আমার সেলফোন সহ সব ছিল আমার রুমে উপরে তাই তো আনিকা যে আমাকে ফোন করল তা ও জানতে পারলাম না।

আমি ব্যস্ত ছিলাম কি ভাবে অরিয়ন-৯ এর হাত থেকে পৃথিবীকে বাঁচানো যায়। কিভাবে পৃথিবীর সকল মানুষ গুলোকে বাঁচানো যায়। যখন আমি গবেষণা গারে থাকি তখন আমার আর কোন সময়ের হিসেব থাকে না। আমি সকল হিসেব করে দেখলাম তিনদিনের মধ্যে অরিয়ন-৯ আর পৃথিবীর মধ্যে সংঘর্ষ হবে। কিন্তু যা করার তা তিন দিনের আগেই করতে হবে পৃথিবীর কাছাকাছি আসলে ও কিছু করা যাবে না। আমি সময় নিলাম দু দিন। আজ এবং আগামী কাল।

যখন সবাই অরিয়ন-৯ কে ধংশ করে পেলবে বলে আলোচনা করে তখন আমি চিন্তা করলাম অন্য কোন ভাবে কি এ মহা সমস্যার সমাধান করা যায় কিনা।  তিন ভাবে করা সমাধান করা চিন্তা আমার মাথায় আসলো।

1.             অরিয়ন-৯ কে ধংশ করে

2.             একটি ওয়ার্ম হোল তৈরি করে তার মধ্যে দিয়ে অরিয়ন-৯ কে অন্য কোন স্থান ও কালে পাঠিয়ে দিয়ে।

3.             উচ্চ মানের ম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি করে তা দিয়ে অরিয়ন-৯ কে বিকর্ষণ করে দূরে পাঠিয়ে দিয়ে।

আমার নিজের হাতে গড়া  অরিয়ন-৯ কে ধংশ করতে চাইনি বলেই প্রথমটা বাদ দিলাম। তাছাড়া অরিয়ন-৯ কে ধংশ করলে ও তার বর্জ্য পদার্থ গুলো পৃথিবীর বায়ু মণ্ডলে ছড়িয়ে পড়বে।  পুরো বায়ু মণ্ডল হয়ে যাবে তেজস্ক্রিয়, যার ফলাফল হবে ভয়াবহ।

ওয়ার্ম হোল তৈরি করে অরিয়ন-৯ কে অন্য কোন স্থান ও কালে পাঠিয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু আমাদের হাতে যে সময় তা দিয়ে ওয়ার্ম হোল তৈরি ও কাজে লাগানো যাবে না। যা অনেক সময়ের ব্যাপার।

তাই তৃতীয় টাই আমার কাছে সবচেয়ে ভালো লাগলো। তবে উচ্চমানের ম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি করার জন্য প্রয়োজন অনেক শক্তি। তা বহন করে অরিয়ন-৯ এর কাছে পৌছা ও অনেক কঠিন। তবে এটার মধ্যে রিস্ক অনেক কম বলে এ কঠিন কাজ ই বেছে নিলাম।

এডমিনিস্ট্রেশন প্যানেলের সবাইকে বলে দিলাম,  যদি কোন কারণে ম্যাগনেটিক ফিল্ড দিয়ে সমাধান না হয় তাহলে যেন অরিয়ন-৯ কে ধংশ করার ব্যবস্থা রাখা হয়। এটা বলার সময় কেন যেন আমার বুক কেপে উঠলো।

এ সব যোগাযোগ করে সবাইকে প্রয়োজনীয় তথ্য সবাইকে জানিয়ে আমি আমার গবেশনাগারে প্রবেশ করলাম। পরিমাপ করলাম কত বড় ম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি করতে হবে, কি ভাবে তাকে প্রয়োগ করতে হবে। বহন করার জন্য কত বড় লঞ্চার লাগবে। ইত্যাদি সব নির্ণয় করে আমি ওদেরকে সব কিছু প্রস্তুত করার জন্য বলে আমি বের হলাম তখন দেখি আমার ঘড়িতে বিকেল ৬.৩০ বাজে। আমার তখনি মনে পড়ল আজ আনিকার জন্ম দিন ছিল। আমি দ্রুত আনিকাকে ফোন করার জন্য সেল ফোন হাতে নিয়ে দেখলাম অনেক গুলো মিস কল উঠে আছে। তাকে ফোন করলাম দেখলাম তার সেলফোন অফ। তার রুমের সাথে ভিডিও কনফারেন্স করার চেষ্টা করে ও বার্থ হলাম। আমি বুঝতে পারলাম যে আনিকা আমার উপর রাগ করছে। আমি ওর বাসায় গিয়ে দেখলাম  দরজা বন্ধ করে আছে। ভিতরে কেউ কি আছে না নেই তার কোন খবর নেই। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আমি চলে আসলাম। গতকাল রাতে ঘুম না যাওয়ার কারণে চোখে অনেক ঘুম।

এ দিকে আমার হাতে সময় কম, ম্যাগনেটিক ফিল্ড লঞ্চ করার জন্য সব কিছু ঠিক করতে সময় লাগবে বলছে ৬ ঘণ্টা। তার মধ্যে এক ঘণ্টা এদিক ওদিক করতে করতেই কেটে গেলো। এত বড় দায়িত্ব অন্য কাউকে দেওয়ার সাহস না পেয়ে আমি নিজেই ম্যাগনেটিক ফিল্ড নিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। ঘুম ঢুলু ঢুলু অবস্থায় নিজেকে তৈরি করলাম। অনেক দিন মহাকাশ স্টেশনে না থাকার কারণে অনেক অসুবিধা হল। তার পর ও নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে গেলাম। এর মধ্যে অনেক বার আনিকার সেলফোনে কল করলাম। বন্ধ। যোগাযোগের সকল চেষ্টা করে আমি বার্থ হলাম।

আমি ম্যাগনেটিক ফিল্ড নিয়ে রকেট লঞ্চারে বসে একটি ছোট্ট ম্যাসেজ দিলাম আনিকাকে “ আমাকে ক্ষমা কর, আর হয়তো ফিরে আসতে পারবো না পৃথিবীর বুকে, দেখতে পারবোনা তোমার সুন্দর হাসি”।

আনিকা হয়তো এতক্ষণে টিভি চ্যানেল থেকে আমার খবর পেয়ে গেছে, কারণ সকল চ্যানেলে রকেট লঞ্চারের সরাসরি সম্পচার করে।

কাউন্ট ডাউন করে রকেট আস্তে আস্তে ম্যাগনেটিক ফিল্ড নিয়ে উপরে উঠে চলছে। আর আমার মনে হচ্ছে আমি আনিকার কাছে থেকে যেন আস্তে আস্তে সরে পড়তেছি।

 

ম্যাগনেটিক ফিল্ড নিয়ে অরিয়ন-৯ এর কাছা কাছি পৌঁছে এবার ম্যাগনেটিক ফিল্ডের সুইচ চালু করলাম। প্রথমেই একটা ঝাঁকুনি খেতে হয়েছে পুরো রকেট নিয়ে। এবার আস্তে আস্তে ম্যাগনেটিক ফিল্ডের তীব্রতা বাড়ালাম। কিন্তু অরিয়ন-৯  বিচ্যুত কক্ষপথ থেকে একটু ও সরে না। আমার সকল কাজের ফলাফল শূন্য করে সে আস্তে আস্তে পৃথিবীর দিকে যাচ্ছে। আমি ম্যাগনেটিক ফিল্ডের তীব্রতা সর্বোচ্চো করে অরিয়ন-৯ এর দিকে ধাবিত হলাম।  অরিয়ন-৯ ও রকেটে পরস্পরকে প্রবল বিকর্ষণ করা শুরু করছে, তাই রকেট একটু ও সামনের দিকে যেতে চায় না।  রকেটের ও সর্বোচ্ছ গতি দিলাম, সকল বিপদ সংকেত বেজে উঠল। স্বয়ংক্রিয় ভাবে কম্পিউটার দায়িত্ব নিতে চাইলো। আমি সকল কিছু উপেক্ষা করে দিলাম। চারদিকে বিপদ সংকেত আর তীব্র বিকর্ষণে যেন আমার মাথা আউলা হয়ে গেছে, আমি তারপর ও রকেটের দায়িত্ব নিজের উপর রেখে চালাতে লাগলাম। হঠাৎ সব কিছু আউলা হয়ে গেছে।তীব্র ঝাঁকুনি খেয়ে রকেট দ্রুত নিচের দিকে পড়া শুরু করছে। আমি কিছুই নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না। অজ্ঞান হয়ে গেলাম।

পরে জানলাম আমি রকেট সহ বঙ্গোপসাগরে পড়ে গেছি, অজ্ঞান অবস্থায় আমাকে উদ্ধার করা হয়। আমার শরীরে জীবন আছে না নেই তা নিয়ে সবাই শঙ্কায় পড়ল।আমার সকল আত্মীয়দেরকে খবর জানানো হলো আমাকে শেষ বারের মত দেখার জন্য।

আমি যখন চোখ খুললাম, দেখলাম আমার মা চোখের পানি নিয়ে কান্না করতেছে। কেউ ভিতরে কেউ বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে, সবার মধ্যে আমি অন্য আরেকটা মুখ খুঁজতে লাগলাম, অবশেষে পেলাম, হাতে এক তোড়া গোলাপ ও গন্ধরাজের তোড়া নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে একটি আতঙ্কিত মুখ। তার চোখের দিকে তাকিয়ে  আমার চোখ দিয়ে অভয় দিলাম আমার কিচ্ছু হয় নি। আমার চোখ আবার ও বুঝে আসলো, একটি মুখের প্রতিচ্ছবি নিয়ে আমি আবারো অজ্ঞান হয়ে গেলাম।

পুনশ্চ: অরিয়ন-৯ কে ম্যাগনেটিক ফিল্ডের সাহায্যে বিচ্যুত কক্ষপথ থেকে সরানো গেছে, এমন কি সে এখন নিজের কক্ষপথ থেকে ও আরো ভালো পৃথিবীর চারদিকের নতুন কক্ষপথে ঘুরছে। কিন্তু আগে কি কারণে তার কক্ষপথ পরিবর্তন হয়ে গেছে তার তদন্ত কাজ চলছে।

 

 

 

1 thought on “সাইন্স ফিকশন – স্টেশন অরিয়ন-৯”

Leave a Reply