শেখা

নাবিদ আর জয়ার সম্পর্কটা খুব ভাল লাগত আমার। নাবিদ আমার বন্ধু। মাঝে মাঝে আমি সিঙ্গেল দেখে আমাকে বিভিন্ন টিপস দিত। সেই টিপস গুলোর উল্টোটা করে দিন গুলো পার করে দিচ্ছিলাম। তাদের বিয়ে হবে হবে করছে। দুই পরিবারই রাজি। আমি অপেক্ষা করছি তাদের বিয়ে খাওয়ার।

মায়ের জন্য একদিন শাড়ি কিনতে গিয়েছিলাম। দুইটা শাড়ি পছন্দ হওয়ায় কোনটা নেব, বুঝে উঠতে পারছিলাম না। পাশেই জামা পছন্দ করা একটি মেয়েকে জিজ্ঞেস করে বসলাম কোনটা ভালো হবে। সুন্দর করে হেসে আমাকে একটি দেখিয়ে দিল। ঐ দিনের গল্প ঐখানেই শেষ।

কাবাবের হাড্ডির মত নাবিদ আর জয়ার সাথে একটা রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলাম ঐদিন। এটা ওটা নিয়ে গল্প হচ্ছিল। দেখলাম একটি মেয়ে এদিক ঐদিক তাকাচ্ছে। বসার মত একটা টেবিলও খালি নেই। ভালো করে খেয়াল করে বুঝলাম শপিং মলে দেখা হওয়া মেয়েটি। পাশ দিয়ে চলে যাওয়ার সময় আমি দাঁড়িয়ে বললাম চাইলে আমাদের সাথে বসতে পারেন। আমি একটু শংকিত ছিল চিনতে পারে কিনা। না চিনলে তো কিনা কি ভেবে বসে। মেয়েটি চিনতে পারল। আমি ছোট্ট করে একটা ধন্যবাদ দিলাম, বললাম মা শাড়িটি পছন্দ করেছেন। একটু করে হাসল। জিজ্ঞেস করল বসলে আমাদের সমস্যা হবে কিনা। জয়া বলল কোন সমস্যা হবে না। বসতে।

নাবিদ মুচকি মুচকি হাসে। আমি বুঝতে পেরেছি কেন হাসে। হয়তো ভেবেছে মেয়েটির সাথে আমার কোন সম্পর্ক আছে আর আমি তার থেকে লুকিয়েছি। সত্যি কথা হচ্ছে আমি মেয়েটির নামও জানি না।

কিছুক্ষণের জন্য আমাদের টেবিলটা কেমন নিরব হয়ে গেলো। কেউ কোন কথা বলছে না। আমিও কি বলব বুঝতে পারছি না। মুক্তি দিল জয়া। জয়া নিজের পরিচয় দিল। মেয়েটি উত্তরে নিজের নাম বলল। লিনা। আমি লিনার মুখের দিকে তাকালাম। কেমন স্নিগ্ধ একটা মুখ। চোখা চোখি হতে আমি অন্য দিকে ফিরলাম। কি লজ্জা। আমাদের তিনজনের সামনে স্মুথি। ওয়েটারকে ডেকে লিনার জন্যও অর্ডার দিলাম।

আমরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গল্প করলাম। নিজের সম্পর্কে জানালাম। লিনার সম্পর্কে জানলাম। লিনা পড়ালেখা শেষে করেছে বেশি দিন হয়নি। জব খুঁজছে। আমরা খাওয়া দাওয়া করলাম। এরপর রেস্টুরেন্ট থেকে বের হলাম। লিনাকে এগিয়ে দেওয়ার সময় ফেসবুক আইডি চেয়ে রিকোয়েস্ট পাঠালাম।

কিছুক্ষণ পরেই লিনা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট করল, সাথে একটা মেসেজ। ট্রিটের জন্য ধন্যবাদ দিল। আমি বললাম ট্রিট দিয়েছে নাবিদ। লিনা বলল তাহলে সিটের জন্য ধন্যবাদ। আমি হাসলাম। এটা ঐটা নিয়ে কথা হলো। ফেসবুক থেকে হোয়াটসঅ্যাপে। এরপর ফোনে।

আমরা জীবনে ঘটে যাওয়া নানান গল্প করতে লাগলাম। এক সময় নতুন গল্প সাজাতে লাগলাম। আমাদের গল্প।

আমাদের গল্প সাজানোর আগেই ভেঙ্গে দিল লিনার বাবা। আমার মত ছোট চাকুরেজীবির সাথে মেয়ের বিয়ে দিলে মেয়ের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। লিনাকে ইচ্ছে মত কথা শুনিয়ে দিল। এরপরও লিনা আসত মাঝে দেখা করতে। কথা হতো। তাও বন্ধ হয়ে গেলো যখন লিনার বাবা তার থেকে মোবাইলটা নিয়ে গেলো। একদিন শুনলাম কানাডা প্রবাসী পাত্রের সাথে তার বিয়ে। আমার খুব ইচ্ছে করছিল বিয়ের সাজে লিনাকে দেখতে। দেখা হয়নি। এরপর একসময় প্রবাসী বরের সাথে কানাডায় পাড়ি দিল। লিনা আমার কাছ থেকে দূরে চলে গেলো। কত দূর।

প্রথম দিকে কেমন প্রচন্ড মন খারাপ লাগত। বিষন্ন লাগত সব কিছু। এরপর আস্তে আস্তে কেমন জানি রোবটের মত সব করে যেতে লাগলাম। অনুভূতিহীন হয়ে পড়লাম। নাবিদের সাথে দেখা হলে বলত নতুন কাউকে খুঁজে নিতে। নতুন কাউকে খুঁজে নেওয়ার মত মন আমার নেই। লিনাকে নিয়ে যে গল্প গুলো সাজিয়েছি, সে গুলোকে সুন্দর করে নিজের মনে রেখে দিয়েছি। সে গল্প গুলোর কথা মনে করেই দিন গুলো সুন্দর করে পার করে দিচ্ছি।

একদিন শুনি নাবিদ আর জয়ার ছাড়া ছাড়ি হয়ে গিয়েছে। নিজের কাছে কেমন কষ্ট লেগেছে। এদেরকে দেখে ভাবতাম প্রেম ভালোবাসা কত সুন্দর। কত সুন্দর সম্পর্ক ছিল। এই সুন্দর সম্পর্ক ভাঙ্গার দায়ে দুইজনকেই আমার কাঠ গোড়ায় দন্ড দিলাম। দুইজনের সাথেই যোগাযোগ বন্ধ করলাম।

কিছুদিন পর নাবিদ আমার বাসায় এসেছে। হাতে একটি কার্ড। তার বিয়ের কার্ড। আমি জিজ্ঞেস করলাম কার সাথে বিয়ে? জয়ার সাথে? বলল না। আমি বলল ‘ও’। এটা সেটা নিয়ে কথা হল কিছুক্ষণ। বলল আমিও যেন কাউকে খুঁজে নেই। বিয়ে করে ফেলি। বয়স তো আর কমছে না। আমি বললাম দেখি। নাবিদদের দেখেই প্রেম করা শিখেছি। মনে হচ্ছে আমার কিচ্ছু শেখা হয়নি। শেখা হলে হয়তো আমিও অন্য কাউকে বিয়ে করে নিতে পারতাম। কিন্তু আমি পারি না। পারতে চাইও না। না পেরেই সময় গুলো পার হয়ে যাচ্ছে। সামনের সময় গুলোও হয়তো পার হয়ে যাবে।

1 thought on “শেখা”

Leave a Reply