কোথাও ঘুরতে যেতে ইচ্ছে করছিল। চিন্তা করলাম বান্দরবন থেকে ঘুরে আসি। সহজ থেকে হানিফের একটি টিকেট কেটে নেই। সহজে দেখলাম সিট সিলেক্ট করা যায়। সামনের সিটটা সিলেক্ট করে টিকেট কেটে নেই। বাস ১১.১৫ তে। আরামবাগ থেকে উঠতে হবে। আমি সাড়ে নয়টার দিকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে রওনা দেই। ১০.১৫ এর মধ্যে আরামবাগ পৌঁছে যাই। কাউন্টারে এসে সহজের টিকেট দেখালে আমাকে একটা টিকেট প্রিন্ট করে দেয়।
কোটা আন্দোলন নিয়ে কত কিছুই হলো। প্রথম শ্রেণী এবং দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরি থেকে কোটা বাতিল করা হলো। দেখলাম কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরা এই কোটা ফিরিয়ে আনার জন্য শাহাবাগ আন্দোলন করছে। শাহাবাগ যান চলাচল বন্ধ। এ জন্য বাস আসতে দেরি হচ্ছিল। ১১.১৫ এর জায়গায় প্রায় ১২টার দিকে আমরা রওনা দেই। রাস্তায় তেমন একটা জ্যাম ছিল না।
দুইটার মধ্যে কুমিল্লা পৌঁছে যাই। আইরিশ হিলে যাত্রা বিরতি দেয়। খাওয়া দাওয়া করে আবার রওনা দেই। এরপর কিছুক্ষণ ঘুমে, কিছুক্ষণ জেগে দেখতে দেখতে বান্দরবন পৌঁছে যাই। তখন সম্ভবত সকাল সাড়ে সাতটা।
বান্দরবন একা একা ঘুরা ঝামেলা। কারণ যেখানেই যেতে চাই না কেন, গাড়ি রিজার্ভ করে ঘুরতে হয়। একা একজনের জন্য বিশাল একটা গাড়ি রিজার্ভ করা ইফিশিয়েন্ট না। আমি ভাবলাম কোন একটা গ্রুপের সাথে শেয়ার করব। একটা গ্রুপ ছিল, প্রায় ৩০ জনের মত। তারা দুইটা গাড়ি বুক করেছে। ওরাই কষ্ট করে বসছিল, তাই আর তাদের সাথে না যাওয়াই ভালো মনে করছিলাম। পাশে কলাপাতা রেস্টুরেন্ট নামে একটা রেস্টুরেন্ট আছে। আমি বসে সকালের নাস্তা করে নিলাম। খাবার দাবার মোটামুটি ভালো। খুব সুন্দর করে এক মগ লেবু চা তৈরি করে দিয়েছিল। খাওয়া দাওয়া করে আমি রওনা দিলাম রুমা বাস স্ট্যান্ড। গন্তব্য বগালেক।
রুমা বাস স্ট্যান্ড থেকে সম্ভবত প্রতি ঘণ্টা পর পর রুমাতে বাস যায়। আমরা এর আগে একবার বগালেক আসি। ২০১২ এর দিকে। অনলাইনে পরিচিত কিছু ফ্রেন্ডদের সাথে। তখন শীতকাল ছিল। তখনো বগালেক যাওয়ার জন্য আমরা রুমা পর্যন্ত বাসে করে যাই। এরপর সম্ভবত বিকেল হয়ে যাওয়ার কারণে আমাদের রুমা থেকে যেতে হয়। পরের দিন সকালে চান্দের গাড়ি করে বগালেক যাই।
রুমা যাওয়ার বাস ১০টায় ছাড়ে। লোকাল মানুষদের সাথে রওনা দেই। পথে দেখলাম রাস্তা ঠিক করা হচ্ছিল। আমাদের কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হচ্ছিল রাস্তা ঠিক করা পর্যন্ত। এরপর বারোমাইল নামক একটা জায়গায় বাস থামে। ৬ বছর আগেও ঠিক একই জায়গায় যাত্রা বিরতি দিয়েছিল। একটা বট গাছ ছিল, ঐটা এখনো আছে। মনে আছে বটগাছের নিছে আমরা রেস্ট নিচ্ছিলাম। কেউ কেউ বট গাছে ঝুলছিলাম।
রুমা পৌছাই ১টার দিকে। আমি ভাবলাম লোকাল যে সব মানুষ বগালেক যায়, তাদের সাথে চলে যাবো। কিন্তু এখানে জানালো একা একা যাওয়া যাবে না। ট্যুরিস্ট যে কেউ ঐ দিকে যেতে হলে গাইড নিয়ে যেতে হবে। ফরম পূরণ করতে হবে ইত্যাদি। পরে ঐখানের গাইডেরা জানালো কোন গ্রুপ আসলে তাদের সাথে যাওয়া বেটার হবে। আমি অপেক্ষা করি কিছুক্ষণ। ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে নেই।
কিছুক্ষণ পর ৮ জনের একটা টিম আসে। পরে উনাদের সাথে কথা বলে নেই। ফরম পূরণ করা, সেগুলো আর্মি ক্যাম্পে জমা দেওয়া, জীপ ঠিক করা, পুলিশ বক্সে আবার নাম এন্ট্রি করা সব ফর্মালিটি শেষ করতে করতে ৩টা বেজে গেলো। আমরা এরপর রওনা দেই বগালেকের দিকে।
বগালেক পর্যন্ত জীপে করে যাওয়া যায় না। ৪০ মিনিটের মত হাঁটতে হয়। আমাদের নামিয়ে দেওয়ার পর দেখলাম একটা ট্রাক পাথর নিয়ে বগালেকের দিকে যাবে। বালি আর কাঁদার মধ্যে হাঁটার থেকে ট্রাকে করে চলে যাওয়া ভালো। আমি ট্রাকে উঠে পড়লাম। আমার মনে আছে এর আগের বার যখন বগালেক এসেছি, তখনো ট্রাকে করেই কেওকারাডং পর্যন্ত চলে গিয়েছি।
এই রাস্তা টুকু অনেক খাড়া। হেঁটে আসা অনেক কষ্টকর। এছাড়া ট্রাক গুলোও উঠতে অনেক কষ্ট হয়। ভয়ঙ্কর একটা রাস্তা। ভাঙা এবং অনেক খাড়া। বগালেক পৌঁছাতে বেশিক্ষণ লাগে নি যদিও। বগালেকের আর্মি ক্যাম্পের সামনে আমাকে নামিয়ে দিল। ট্রাক ড্রাইভারকে টাকা দিতে চাইলে নেয়নি। বলল লাগবে না। ফ্রি ফ্রি একটা রাইড পেয়ে গেলাম।
এর আগে যখন এখানে এসেছি, কেমন একটা শান্ত পরিবেশ ছিল। এখনও শান্ত পরিবেশই। এরপর ও মনে হচ্ছিল কত কিছুই পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। এখানে আগে সুন্দর একটা খোলা যায়গা ছিল। উঠানের মত। এখন রাস্তা করার জন্য গর্ত করে রেখেছে। সৌন্দর্যটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। লেকটা আগের মতই আছে যদিও।
আমরা উঠেছি বগালেকের প্রথম কটেজটিতে। খুব বেশি পর্যটক নেই। রাতে বের হলাম একটু হাঁটতে। চাঁদের আলো নেই খুব একটা। কিন্তু আকাশের দিকে তাকালে কত শত তারা দেখা যায়। খুব সুন্দর লাগে। দিনে এত পরিষ্কার আকাশ ছিল না। রাতে তারা গুল খুব পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল।
রাতে খাওয়া দাওয়া করি মিষ্টি কুমড়া, আলু ভর্তা, ডাল আর ডিম দিয়ে। এরপর ঘুমিয়ে পড়ি।
এখানের থাকার ব্যবস্থা ৬ বছর আগে যেমন দেখে গিয়েছি, তেমনই। রুমে কোন খাট নেই। গন বিছানা। এক রুমে ১৫-২০ জন ঘুমানো যায়। এক রাত্র থাকার জন্য ১৫০ টাকা। খাবারের ব্যবস্থাও গন খাবারের মত। ১২০ টাকা প্যাকেজ। এর মধ্যে সবজি, আলু ভর্তা, ডিম, ডাল ইত্যাদি।
রাতে আগে ঘুমানোর কারণে সকালে একটু আগেই ঘুম ভেঙ্গে যায়। এত বেশি নির্জন। শুধু কিছু পোকা এবং পাখির ডাক শোনা যায়। সকালের আবহাওয়াটা একটু ঠাণ্ডা। দারুণ। সকালে ফ্রেশ হয়ে বগালেকের আশে পাশে ঘুরেছি কিছুক্ষণ। এরপর বগালেকে গোসল করি। শীত কালে যখন এসেছি, তখন ঠান্ডা পানিতে গোসল করার সাহস হয়নি। আমি ভেবেছি একটু সাঁতার কাটা যাবে। কিন্তু এখানে সাঁতার কাটা নিষিদ্ধ। বুক পানির বেশি নামা নাকি নিষিদ্ধ। যতক্ষণ লেকে ছিলাম, গাইড ততক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। আমি যদি সাঁতার কাটি, তাকে আর্মিরা ধরবে নাকি। এ জন্য আর সাঁতার কাটা হয়নি।
সকালে নাস্তা খেয়ে আমরা বগালেক থেকে রুমার দিকে রওনা দেই। আর্মি ক্যাম্পে সাইন আউট করে হাঁটতে থাকি। একটা ট্রাক যাচ্ছিল, ঐটাতে উঠে পড়ি। অর্ধেক রাস্তা ট্রাকে উঠে পার হই। বাকি পথ হেঁটে জীপ যেখানে নামিয়ে দিয়েছিল, সেখানে পৌছাই। এরপর জীপে করে রওনা দেই রুমাতে। দুই পাশের পাহাড় গুলো কি যে ভাল লাগছিল। সাজেক যাওয়ার রাস্তা অনেক খাঁড়া জানি, কিন্তু রুমা থেকে বগালেক যাওয়ার রাস্তা মনে হয়েছিল আরো বেশি খাঁড়া। এছাড়া এখন সব কিছু একটু বেশি সবুজ। শীত কালে সবুজের পরিমাণ কমে যাবে। আকাশ ও একটু গোলা থাকবে। পরিষ্কার আকাশে দূরের পাহাড় ও কি সুন্দর দেখা যায়। ভালো না লেগে পারা যায় না।
রুমাতে পৌঁছে যে টিমের সাথে গিয়েছি, তাদের থেকে বিদায় নেই। ওরা আমার থেকে বেশি টাকা নিয়েছে। ছোটলোকের মত জানালো আমি একা গেলে আরো অনেক বেশি খরচ হতো ব্লা ব্লা। টাকার পরিমাণ বেশি না। এরপর ও কেমন খারাপ লাগল। খারাপ লাগার কারণ ওরা বলার আগেই আমি বেশি টাকা দিয়েছিলাম, এরপর ও আরো যখন চেয়েছে, তখন খারাপ লাগল। কথা না বাড়িয়ে আমি টাকা দিয়ে দেই।
রুমা থেকে আমার প্ল্যান ছিল নীলগিরি যাওয়ার। কিন্তু সরাসরি কোন বাস নেই। সবাই বলল আমি যেতে যেতে বিকেল হয়ে যাবে। তখন আবার নীলগিরি থেকে ফেরার কোন যান পাবো না। পরে বাসে করে বান্দরবন ফিরে আসি।
বান্দরবন ফিরে এসে দুপুরের খাবার খেয়ে নেই। এরপর ঢাকা ফেরার টিকেট কেটে নেই। বাসস্ট্যান্ড থেকে একটা অটো নিয়ে চলে যাই নীলাচল। নীলাচল শহরের কাছেই। অনেক বড় এরিয়া জুড়ে। পাহাড়ের উপর থেকে চারপাশের ভিউ দেখা যায়। দেখা যায় বান্দরবন শহরের ভিউ। নীলাচল থেকে বাসস্ট্যান্ড ফিরে এসে রওনা দেই স্বর্ণ মন্দির দেখতে।
মন্দিরটা সুন্দর। পাহাড়ের উপর। কিছুদূর হাঁটতে হয়। মন্দিরের উপর থেকে চারপাশ সুন্দর দেখা যায়। মন্দির দেখে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। বান্দরবন শহরে এসে হাঁটাহাঁটি করি কিছুক্ষণ। খাওয়া দাওয়া করে নেই কিছু। বাস সাড়ে নয়টায়। এরপর সময় হলে বাসে উঠে ঢাকার দিকে রওনা দেই। বান্দারবান দেখার মত অনেক কিছু আছে। যদি আল্লাহ সুযোগ দেয়, হয়তো আবার ও কোন এক সময় চলে যাবো। পাহাড় দেখতে। পাহাড়ের সাথে মিশে যেতে।
অনেক ভাল তথ্য বহুল একটি পোস্ট পড়ে অনেক তথ্য জানতে পারলাম।