উমরা করার অভিজ্ঞতা এবং নিয়ম

দুবাই থেকে প্রতি সপ্তাহে বিভিন্ন ট্যুর কোম্পানি উমরা করতে নিয়ে যায়। বাসে অথবা এয়ার, দুই রকম প্যাকেজই আছে। আমরা বাসে যাওয়ার প্যাকেজ নিয়ে নেই। ডিসেম্বরের এগারো তারিখে যাওয়ার প্ল্যান করি।

এজেন্টকে পাসপোর্ট কপি দেওয়ার পর তারা উমরা ভিসা এর জন্য পিঙ্গার প্রিন্ট এবং ছবি তোলার জন্য তারিখ নিয়ে দেয়। ডিসেম্বরের পাঁচ তারিখে গিয়ে VFS এ গিয়ে আমরা প্রিঙ্গার প্রিন্ট এবং ছবি তুলে আসি।

১০ তারিখ ফোন করে জানায় যে পরের দিন ৯টায় বাস ছাড়বে, আমরা যেন সময় মত তাদের অফিসে গিয়ে থাকি। উমরাহ করতে যাবো, এটা মনে হলেই কেমন একটা ভালো লাগা অনুভব হতো। রাতে ব্যাগ প্যাক করে রাখি। সকালে চলে যাই বাস যেখানে অপেক্ষা করে, সেখানে। শারজাহ থেকে উঠব বলেছি আমরা। সেখানে অন্যান্যরাও অপেক্ষা করতেছিল। কেউ কেউ আসতে দেরি করছিল। এভাবে করতে করতে বাস শারজাহ থেকে ছাড়ে সাড়ে দশটার দিকে।

এরপর দুবাই গিয়ে আবার থামে বাস। দুবাই থেকে বাকি প্যাসেঞ্জারদের নিয়ে রওনা দিতে দিতে দুপুর একটা।

এত বড় বাস জার্নি এর আগে কখনো করিনি। এবারই প্রথম। রাতে না ঘুমানোর কারণে প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছিল। ঘুমাচ্ছিলাম আমরা। বিকেলের দিকে আবুধাবি পৌঁছাই। নামাজ এবং খাওয়ার জন্য বাস থামে। নামাজ পড়ে এবং খাওয়া দাওয়া করে এরপর আবার রওনা দেই। সন্ধ্যা আটটার দিকে সৌদি বর্ডারে পৌঁছাই। UAE সাইডে আমাদের সময় লাগেনি খুব একটা। মাগরিবের নামাজ পড়তে পড়তেই বাস ড্রাইভার গিয়ে পাস্পোর্টে এক্সিট সিল মেরে আসছিল। আলাদা কিছুই করতে হয়নি। অনেক গুলো বাস যাচ্ছিল সৌদি আরব। বেশির ভাগই উমরা করার জন্য। বর্ডারে অনেক সময় লাগছিল। ব্যাগ চেকিং পুরাই ম্যানুয়াল। বাস থেকে সব কিছু নামিয়ে ব্যাগ খুলে একে একে চেক করছিল। তাও একজন মাত্র লোকে চেক করতেছিল। হেল্প করার জন্য অনেকেই ছিল যদিও। এরপর ও অনেক অনেক সময় লাগছিল এভাবে সব চেক করাতে। ইমিগ্রেশনেও অনেক সময় লেগেছিল। ইমিগ্রেশন পার হতে হতে প্রায় রাত আড়াইটা বেজে গিয়েছিল।

বাংলাদেশের টয়লেট দেখে অনেক সময় অনেক কথা বলতাম। সৌদি আরবের এই টয়লেট গুলো দেখে মনে হলো বেশির ভাগ পাবলিক টয়লেটই হরর মুভির মত। ঢুকার পরই চিন্তা করতে থাকি কখন এ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।

রাতে খুব বেশি কিছু দেখা যাচ্ছিল না। রাস্তা কি যে সোজা। মরভূমির মাঝে দিয়ে। ড্রাইভার লোকটা বাদাম খাচ্ছিল আর গাড়ি চালাচ্ছিল। এক সময় দেখলাম একটা বাসে আগুণ ধরে রাস্তায় পড়ে আছে। যাত্রীরা নিচে দাঁড়িয়ে ছিল। পুলিশ আমাদের বাসকে অন্য পাশ দেখিয়ে দিচ্ছিল। বাসে এভাবে আগুণ দেখে কি যে ভয় পেয়েছি। পুরো বাস পুড়ে শেষ।

প্রায় দুই হাজার কিলোমিটারের মত দূরুত্ব। ড্রাইভার বাস চালাচ্ছে তো চালাচ্ছে। মাঝে মধ্যে নামাজ পড়া, খাওয়ার বিরতি দিত। আমরা তো বেশির ভাগ সময় ঘুমিয়ে কাটাতাম, রেস্ট নেওয়ার সুযোগ পেতাম। ড্রাইভার সাহেবের কোন কিছুরই সুযোগ ছিল না। ভাবতে লাগলাম কিভাবে এত দূরের পথ একটানা ড্রাইভ করতে পারে!

আমরা রওনা দেই বুধবারে। মিকাত পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমাদের পরের দিন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। ঐখানে থেমে আমরা ইহরামের কাপড় কিনে নেই। এরপর মিকাতে গিয়ে গোসল করে ইহরাম বেঁধে নেই। এখানে সুন্দর গোসলের ব্যবস্থা রয়েছে। তারপর এশার নামাজ এবং দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে নেই। মিকাত থেকে মক্কা প্রায় ৯০ কিলো মিটারের মত দূরত্ব। প্রায় এক ঘণ্টার রাস্তা। হৃদ-কম্পন বেড়ে গিয়েছিল, টের পাচ্ছিলাম। কেমন একটা দারুণ অনুভূতি।

মক্কা পৌঁছে আমাদের হোটেলে ড্রপ করে। গাইড একজন এসে আমাদের বিভিন্ন ইন্সট্রাকশন দিয়ে দেয়। Abraj Al Kiswa Towers Hotel নামক একটা হোটেলে উঠি আমরা। হোটেলে ব্যাগ প্যাক রেখে কাবা ঘরের দিকে রওনা দেই, উমরা কমপ্লিট করার জন্য। হোটেল থেকে ২৪ ঘণ্টা বাস আসা যাওয়া করে মসজিদুল হারামে। আমরা বাসে করে রওনা দেই হারামের উদ্দেশ্যে।

এরপর উমরা কমপ্লিট করার জন্য তাওয়াফ শুরু করি। তারপর জমজমের পানি খেয়ে নেই। এবং এরপর সাফা মারওয়াতে গিয়ে সা’ঈ করি। এবং শেষে মসজিদুল হারাম থেকে বের হয়ে চুল কেটে উমরা কমপ্লিট করে হালাল হয়ে নেই। আলহামদুলিল্লাহ, শুকরিয়া আল্লাহর কাছে। প্রায় তিন ঘণ্টার মধ্যেই সব কাজ শেষ হয়ে যায়।

আমরা বের হয়েছিলাম দুপুর রাতের দিকে। ঐ সময় ভিড় অনেক কম থাকে। সুন্দর ভাবে তাওয়াফ করা যায়।

কাবা ঘরের টপ ভিউ – এই ভিউ দেখার জন্য ছাদে যেতে হবে। ছাদে উঠার এস্কিলেটর রয়েছে। একটু খুঁজেলেই পেয়ে যাবেন।

 

পরের দিন শুক্রবার। আমরা জুমাহ পড়তে বের হই। জুমাহ পড়ে খাওয়া দাওয়া করে নেই। তারপর বাকি সময় মসজিদুল হারামে কাটিয়ে দেই। এশার নামাজ পড়ে হোটেলে ফিরি।

আরাফাতের ময়দান

 

Jabal-e-Rehmat

শনিবারে গাইড বলছিল আমাদের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাবে। ৭টার দিকে যেন রুম থেকে বের হয়ে রিসিপশনে আসি। এরপর আমাদের বাসে করে মক্কার বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যায়। এরপর হোটেলে ফিরে আসি।

এর মধ্যে Saifuddin Nowshad ভাই এর সাথে কথা হচ্ছিল। হোটেলে আসার সাথে সাথেই উনার কল। বলল রেডি হয়ে থাকতে। তাইফ যাবে। বলল পারলে হালকা শীতের কাপড় নিয়ে নিতে। আমরা রেডি হয়ে নিচে নামলাম। এরপর রওনা দিলাম তাইফ এর দিকে। উনি, উনার ওয়াইফ, উনার দাদা শ্বশুর, এবং আমি আর নাঈমা। তাইফ পাহাড়ের উপড়ে একটা শহর। মক্কা থেকে কাছেই। পাহাড়ি রাস্তা বলে একটু সময় লাগে যেতে। কি সুন্দর সব পাহাড়। মক্কার পাহাড় গুলো কেমন শুষ্ক, তাইফ এর পাহাড় গুলো সবুজ। দেখতে ভালো লাগে।

তাইফের আল শিফা থেকে ভিউ

তাইফ গিয়ে সুন্দর এক জায়গায় গিয়ে থামলাম আমরা। আল শিফা নামক একটা জায়গায়। চারদিক এত সুন্দর দেখাচ্ছিল। ভালো লাগছিল। অনেক পর্যটকই আসে এখানে মক্কা বা আসে পাশের শহর থেকে। ঐখানে উটের পিঠে চড়লাম। উনারা বাসা থেকে বের হওয়ার সময় অনেক কিছু রান্না করে নিয়ে এসেছেন। পিঠা, নুডুলস, চা সহ আরো অনেক কিছু। বসে খেয়ে নিলাম আমরা। এরপর কিছুক্ষণ এদিক সেদিক ঘুরে ফিরলাম মক্কার দিকে।

রবিবার এবং সোমবার ও আমরা মক্কায় ছিলাম। নামাজের সময় মসজিদুল হারামে গিয়ে নামাজ পড়তাম। এছাড়া সোমবারে আমরা মৃত আত্মীয়দের জন্য কাবা ঘর তাওয়াফ করি।

মদিনা

মঙ্গল বার সকালে রওনা দেই মদিনার উদ্দেশ্যে। আমাদের প্রথম নিয়ে থামায় কুবা মসজিদে। কুবা মসজিদে জোহরের নামাজ এবং দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে নেই। এরপর আমাদের মদিনার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে দেখায়। খেজুর বাগানে নিয়ে যায়। তারপর হোটেলে এসে ড্রপ করে। হোটেল মসজিদে নববীর কাছা কাছি। আমরা আছরের নামাজ পড়তে চলে যাই। কিছুক্ষণ পরই মাগরিবের আজান দেয়। নামাজ পড়ে খাওয়ার জন্য রেস্টুরেন্ট খুঁজি। মক্কায় কাবা ঘরের চার পাশেই অনেক রেস্টুরেন্ট থাকলেও এখানে খুঁজে পেতে কষ্ট হচ্ছিল। অনেক খোঁজা খুঁজির পর একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাবার খেয়ে নেই। যদিও পরে সব কিছু চেনার পর অনেক রেস্টুরেন্টই চোখে পড়ছিল।

কুবা মসজিদ – এর সামনে অনেক কবুতর দেখা যায়।

মদিনা থাকি আমরা শুক্রবার পর্যন্ত। নামাজ মসজিদে নববীতে গিয়ে পড়তাম। এর মধ্যে মহানবী (সঃ) এর রওজা মোবারক জিয়ারত করে নেই। এবং রিয়াজ উল জান্নাতে নামাজ পড়ি। শুক্রবারে জুমার নামাজ পড়ে আমরা UAE এর উদ্দেশ্যে রওনা দেই। বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে শনিবার সন্ধ্যা হয়ে যায়।

মক্কা এবং মদিনা নিয়ে যত বেশি জানতে পারছি, মনে হচ্ছে কত কিছুই অদেখা রয়ে গেলো। আরো কত কিছুই করতে পারতাম। এখন ভাবি, কবে আবার যেতে পারব।

উমরা করার নিয়ম

উমরার জন্য ঘর থেকে থেকে বের হয়ওয়ার সময় বাম পা আগে দিয়ে এই দোয়া পড়বেন:

بِسْمِ اللهِ تَوَكّلْتُ عَلى اللهِ، لاَ حَوْلَ وَلاَقُوّةَ اِلاَّ بِاللهِ

উচ্চারণঃ বিসমিল্লাহি তাওয়াক্কালতু আলাল্লাহি, লা হাওলা ওলা কুওয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহ।

এটা মূলত ঘর থেকে বের হওয়ার দোয়া।

উমরা করার নিয়ম সম্পর্কে আমি যতটুকু জেনেছি, তাই লিখছি এখানে।

১. উমরার জন্য ইহরাম বাঁধা (ফরজ)

মিকাত অতিক্রমের আগেই ইহরামের কাপড় পরে নিতে হবে। ইহরামের আগে গোসল বা পরিষ্কার হয়ে নেওয়া সুন্নত। ইহরাম বাঁধার আগে সুগন্ধি ব্যবহার করা যাবে এবং তা সুন্নত। কিন্তু ইহরাম বাঁধার পর সুগন্ধি ব্যবহার নিষিদ্ধ। ইহরাম বাঁধার পর উমরার নিয়ত করে তিনবার তালবিয়া পড়ে নিলেই ইহরাম এর যাবতীয় নিয়ম গুলো মেনে চলা শুরু করতে হবে।

উমরার নিয়ত হচ্ছেঃ

لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ بِعُمْرَةٍ

বাংলা উচ্চারণঃ লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা বি উমরাতিন
অর্থ- হে আল্লাহ! উমরাকারী হিসেবে আপনার দরবারে হাজির।

তালবিয়া হচ্ছেঃ

لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ ، لَبَّيْكَ لا شَرِيكَ لَكَ لَبَّيْكَ ، إِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ لا شَرِيكَ لَكَ

বাংলা উচ্চারণঃ লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়াননি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারিকা লাকা। 

অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমি তোমার দরবারে হাজির, আমি তোমার দ্বারে উপস্থিত, আমি হাজির, তোমার কোনো অংশীদার নেই, তোমার দরবারে উপস্থিত হয়েছি। নিশ্চয়ই সকল প্রশংসা ও নিয়ামতের সামগ্রী সবই তোমার, (সর্বযুগে ও সর্বত্র) তোমারই রাজত্ব, তোমার কোনো অংশীদার নেই।

মহিলারা আস্তে আস্তে তালিবা পড়বেন। পাশে যদি নন মাহরাম থাকে, তাহলে মনে মনে তালিবা পড়বেন।

যে ব্যক্তি ইহরাম করতে যাচ্ছেন তিনি যদি কোন কারণে উমরা শেষ করতে না পারার আশংকা করেন তাহলে ইহরাম বাঁধার সময় শর্ত করে নেওয়াই উত্তম হবে। ইহরামকালে তিনি বলবেন:

إِنْ حَبَسَنِيْ حَابِسٌ فَمَحِلِّيْ حَيْثُ حَبَسْتَنِيْ

বাংলা উচ্চারণঃ ইন হাবাসানি হাবেস ফা মাহিল্লি হাইসু হাবাসতানি। 

অর্থ- যদি কোন প্রতিবন্ধকতা- যেমন রোগ, বিলম্ব ইত্যাদি আমার হজ্ব পালনে- বাধা হয়ে দাঁড়ায় তাহলে আমি যেখানেপ্রতিবন্ধকতার শিকার হই সেখানে ইহরাম থেকে হালাল হয়ে যাব।

মীকাত অতিক্রম করার পূর্বেই ইহরাম বাঁধতে হয়। অনেকর ধারণা যে ইহরাম বাঁধার পর তা পরিবর্তন করা যায় না। যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে ইহরামের কাপড় পরিবর্তন করা যায়। যেমন কারো ইহরামের কাপড় অপবিত্র হয়ে গেলো, তাহলে তো তা পরিবর্তন করতেই হবে।

ইহরাম বাঁধার পর উপরের অংশ দিয়ে দুই কাঁধ ঢেকে রাখতে হবে। অনেকে দেখা যায় ডান কাঁধ খুলে রাখেন। ডান কাঁধ শুধু মাত্র কাবা ঘর তাওয়াফ করার সময় খুলে রাখতে হয়। এর আগেও না, পরেও না।

উমরার ক্ষেত্রে ইহরামের শুরু থেকে তওয়াফ শুরু করার আগ পর্যন্ত তালবিয়া পড়া যাবে। তওয়াফ শুরু করলে তালবিয়া পড়া ছেড়ে দিতে হবে।

ইহরাম বাঁধার পর দুই রাকাত নফল নামাজ পড়া যেতে পারে। এটা অপশনাল। ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ বিষয়াবলী সম্পর্কে এখানে বিস্তারিত জানতে পারবেন। এগুলো মেনে চলতে হবে।

 

মসজিদে হারামে প্রবেশের সময় ডান পা আগে দিয়ে নিচের দোয়া পড়বেন:

بسم الله والصلاة والسلام علي رسول الله اللهم افتح لي ابواب رحمتك

বাংলা উচ্চারণঃ বিসমিল্লাহি ওয়াসসালাতু ওয়াসসালামু আলা রাসুলিল্লাহ, আল্লাহুম্মাফ তাহলি আবওয়াবা রাহমাতিক।

এটা মূলত যে কোন মসজিদে প্রবেশের দোয়া।

কাবা ঘর প্রথমবার চোখে পড়লে সূরা ফাতিহা পড়তে পারেন এবং যে কোন দুয়া করতে পারেন।

২) কাবা ঘর তাওয়াফ (ফরজ)

তাওয়াফের শুরুতে ইজতেবা করতে হবে। ইজতেবা মানে হচ্ছে ডান কাঁধ খালি রেখে চাদরের মাঝের অংশ বগলের নীচ দিয়ে এনে চাদরের পার্শ্ব বাম কাঁধের উপর ফেলে দেয়া।

হাজরে আসওয়াদকে (কালো পাথরকে) সামনে রেখে তাওয়াফ শুরু করতে হয়। হাত তুলে হাজরে আসওয়াদের দিকে তাকিয়ে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে তাওয়াফ শুরু করতে হবে। তাওয়াফ করার সময় কাবা ঘর বাম দিকে থাকবে। পুরুষের জন্য প্রথম তিন চক্করে ‘রমল’ করা সুন্নত । ‘রমল’ অর্থ বীরের মতো বুক ফুলিয়ে কাঁধ দুলিয়ে ঘন ঘন কদম রেখে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলা।

এ সময় যে কোন দোয়া পড়া যায়। দোয়ার পাশা পাশি আল্লাহর প্রশংসা করতে পারেন। এ সময়টা হচ্ছে দোয়া কবুলের সময়। বাংলায় নিজের ভাষায়ও দোয়া করতে পারেন। আল্লাহ সর্বজ্ঞানী।

হাজরে আসওয়াদ যদি প্রথম কোনা ধরি, তাহলে চতুর্থ কোনা হচ্ছে রুকুনে ইয়ামিন বা ইয়ামিনি কর্ণার। যদি পারা যায়, ইয়ামেনি কর্ণার তাহলে হাত দিয়ে স্পর্শ করতে পারেন। চুমু খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। অনেকেই একটু ধরার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে, চুমু খায় বা ধাক্কা ধাক্কি করে। এসব থেকে বিরত থাকুন। হাত দিয়ে ধরা সম্ভব না হলে তাওয়াফ করা চালিয়ে যান।

রুকনে ইয়ামানি থেকে হাজরে আসওয়াদের মাঝখানে নিচের দোয়া পড়তে হয়ঃ

رَبَّنَا آَتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآَخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ

বাংলা উচ্চারণঃ রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানাতাও ওয়াফিল আখিরাতি হাসানাতাও ওয়াকিনা আযাবান্নার।

অর্থ- হে আমাদের রব! আমাদিগকে দুনিয়াতেও কল্যাণ দান করুন এবং আখেরাতেও কল্যাণ দান করুন এবং আমাদিগকে দোযখের আযাব থেকে রক্ষা করুন।

যত বার পারা যায়, উপরের দোয়া পড়ুন।

এরপর হাজরে আসওয়াদ পর্যন্ত আসলে এক চক্কর পূরণ হবে।

পুনরায় হাজরে আসওয়াদ দিকে তাকিয়ে হাত তুলে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে দ্বিতীয় চক্কর শুরু করুন। এভাবে সাত চক্করে তাওয়াফ শেষ করুন।

তাওয়াফের শুরুতে বা হাজরে আসওয়াদ এর কোণা আসলে ডান হাত দিয়ে হাজারে আসওয়াদ স্পর্শ করবেন ও চুমু খাবেন। যদি হাজারে আসওয়াদে চুমু খেতে না পারেন হাত দিয়ে স্পর্শ করবেন ও হাতে চুমু খাবেন। যদি হাত দিয়ে স্পর্শ করতে না পারেন তাহলে হাজারে আসওয়াদের দিকে মুখ করে হাত তুলে তাকবির বলবেন কিন্তু হাতে চুমু খাবেন না।

অনেকেই হাজরে আসওয়াদ চুমু খাওয়ার জন্য ভিড় করেন অন্যকে কষ্ট দেন, এসব করা যাবে না। এমন করলে উল্টো গুনাহ হবে। কাছে গিয়ে স্পর্শ করা এবং দূর থেকে ইশারা করার সওয়াব সমান। বাড়তি সওয়াব হবে চিন্তা করে কাউকে কষ্ট দিয়ে উল্টো গুনাহগার না হওয়াই উত্তম। অনেকেই কাবা ঘর স্পর্শ করে দাঁড়িয়ে থাকে, এমন কিছু মহানবী (সঃ) করতে বলেন নি। তাই এমন কিছু করা থেকে বিরত থাকবেন।

৩. তাওয়াফের দুই রাকাত নামাজ (ওয়াজিব):

সাত বার তাওয়াফ শেষে মাকামে ইবরাহিমকে সামনে রেখে দুই রাকাত নামাজ পড়তে হবে। হারামের ভেতর অন্য যে কোন জায়গায় পড়লেও হবে। এ জন্য প্রথমে দুই কাঁধ ডেকে নিন। প্রথম রাকাতে সূরা কাফেরুন, দ্বিতীয় রাকাতে সূরা ইখলাস পড়তে পারেন। এরপর দোয়া করবেন। এটা দোয়া কবুলের সময়।

জমজমের পানি পান করাঃ

তাওয়াফ শেষে মন ভরে জম জমের পানি পান করবেন। যতটুকু খাওয়ার পর মনে হবে পেটে আর জায়গা নেই, ততটুকু। জম জমের পানি খাওয়ার সময় নিচের দোয়া পড়তে পারেনঃ

اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ عِلْمًا نَافِعًا وَرِزْقًا وَاسِعًاوَشِفَاءً مِنْ كُلِّ دَاءٍ

বাংলা উচ্চারণ – আল্লাহুম্মা ইন্নি আস আলুকা ইলমান নাফিআ, ওয়া রিজকান ওয়াসিআ, ওয়া শিফাআন মিন কুল্লি দা’ইন।
অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করছি উপকারী ইলম, আর প্রশস্ত রিজিক এবং সর্ব প্রকার রোগ থেকে মুক্তি।

৪) সাফা মারওয়া সাঈ (ওয়াজিব)

সাফা এবং মারওয়া উভয় পাহাড়ের উপর কিবলা মুখি হয়ে প্রতিবার এই দোয়াটা পাঠ করতে হবেঃ

إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِن شَعَآئِرِ اللّهِ فَمَنْ حَجَّ الْبَيْتَ أَوِ اعْتَمَرَ فَلاَ جُنَاحَ عَلَيْهِ أَن يَطَّوَّفَ بِهِمَا وَمَن تَطَوَّعَ خَيْرًا فَإِنَّ اللّهَ شَاكِرٌ عَلِيمٌ

উচ্চারণ : ইন্নাসসাফা ওয়াল মারওয়াতা মিং শাআয়িরিল্লাহি ফামান হাজ্জাল বাইতা আয়ি’তামারা ফালা ঝুনাহা আলাইহি আঁইয়্যাতত্বাওয়াফা বিহিমা ওয়া মাং তাত্বাওওয়াআ খাইরান ফাইন্নাল্লাহা শাকেরুন আলিম।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৫৮)

অর্থঃ নিঃসন্দেহে সাফা ও মারওয়া আল্লাহ তা’আলার নিদর্শন গুলোর অন্যতম। সুতরাং যারা কা’বা ঘরে হজ্ব বা ওমরাহ পালন করে, তাদের পক্ষে এ দুটিতে প্রদক্ষিণ করাতে কোন দোষ নেই। বরং কেউ যদি স্বেচ্ছায় কিছু নেকীর কাজ করে, তবে আল্লাহ তা’আলার অবশ্যই তা অবগত হবেন এবং তার সে আমলের সঠিক মুল্য দেবেন।

সাফা পাহাড়ের উপর প্রতিবার দাঁড়িয়ে উপরের দোয়ার পাশা পাশি কেবলামুখী হয়ে আলহামদুলিল্লাহি আল্লাহু আকবার (اَلْحَمْدُ لِلَّهِ اَللهُ اَكْبَر) বলে এই দোয়াটি তিনবার পড়ে সাফা পাহাড় থেকে মারওয়ার দিকে সাঈ শুরু করতে হবেঃ

لَا اِلَهَ اِلَّا اللهُ وَاللهُ اَكْبَر – لَا اِلَهَ اِلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيْكَ لَهُ – لَهُ المُلْكُ وَ لَهُ الْحَمْدُ يُحْيِى وَ يُمِيْتُ وَ هُوَ عَلَى كُلِّ شَيئ قَدِيْر لَا اِلَهَ اِلَّا الله وَحْدَهُ أنْجَزَ وَعْدَهُ – وَ نَصَرَ عَبْدَهُ وَ هَزَمَ الأحْزَابَ وَحْدَهُ

উচ্চারণ : লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্দাহু লা শারিকালাহু লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হাম্দু ইউহয়ি ওয়া ইউমিতু ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন ক্বাদির। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্দাহু আনজাযা ওয়াহদাহু ওয়া নাসারা আবদাহু হাযাামাল আহযাবা ওয়াহদাহু।’

এছাড়া বাড়তি যে কোন দোয়াই আপনি পড়তে পারেন।
সাফা থেকে মারওয়ার দিকে সাঈ’র শুরুতে সবুজ চিহ্নিত স্থান পড়বে। সেখানে পুরুষরা দৌড়ে অতিক্রম করবে আর নারীরা স্বাভাবিকভাবে হেটে তা অতিক্রম করবেন।

সাঈ করার সময় যে কোন দোয়াই পড়া যায়। দোয়ার পাশা পাশি আল্লাহর প্রশংসা করুন।

সাফা থেকে মারওয়া পর্যন্ত সাত বার সাঈ করতে হবে। সাফা থেকে মারওয়া পর্যন্ত এক, মারওয়া থেকে সাফা পর্যন্ত দুই, আবার সাফা থেকে মারওয়া পর্যন্ত তিন এভাবে সাত বার হবে। সপ্তম বার মারওয়াতে পৌঁছে মন খুলে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে পারেন।

হারাম থেকে বের হওয়ার সময় নিচের দোয়া পড়ুন।

سم الله والصلاة والسلام علي رسول الله اللهم اني اسئلك من فضلك.

বাংলায় উচ্চারণঃ বিসমিল্লাহ ওয়াস সালাতু ওয়াস সালামু আ’লা রাসূলিল্লাহ আল্লাহুমা ইন্নি আসআলুকা মিন ফাদ্বলিক।
এটা মূলত মসজিদ থেকে বের হওয়ার দোয়া।

৫) হলক করা (ওয়াজিব)

পুরুষ হলে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আদর্শের অনুসরণে সম্পূর্ণ মাথা ন্যাড়া করবেন। তবে মাথার চুল ছাঁটতেও পারেন। নারী হলে চুলের মাথা এক ইঞ্চি পরিমাণ কাটতে হবে। নারীদের চুল কাটতে হয় মাহারামের দ্বারা, পর্দার ভেতর। বাসায় এসেও কাটতে পারেন। আর তাই যদি পারেন, ছোট্ট একটা কাঁচি রাখতে পারেন লাগেজে। এয়ারে গেলে হ্যান্ড ব্যাগে কাঁচি নিতে দিবে না। আর লাগেজে এক জোড়া নরমাল স্যান্ডেল রাখতে পারেন। উমরা করতে ঢুকার সময় যদি জুতা বাহিরে বা কোথাও রেখে যান, তাহলে তা খুঁজে না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তাই নরমাল এক জোড়া স্যান্ডেল রাখতে পারেন, যেন হারিয়ে গেলে সমস্যা না হয়। অন্যান্য সময় নামাজ পড়তে গেলে সাথেই রাখতে পারবেন।

এ পর্যন্ত ওমরাহর কাজ শেষ। আপনি হালাল। যে কোন কাজ এখন করতে পারেন।

দোয়া গুলো মনে রাখতে না পারলে মোবাইল বা দোয়ার বই দেখে পড়তে পারেন। উত্তম হয় আগে থেকেই প্রিপারেশন নিয়ে দোয়া গুলো মুখস্থ করে ফেলা। উমরা করার নিয়ত করলে ভিসা প্রসেসিং সহ অন্যান্য যে সময়, তাই যথেষ্ট দোয়া গুলো মুখস্থ করার জন্য।

আমি এখানে যা লিখেছি, তা অনলাইনে বিভিন্ন আর্টিকেল পড়ে লিখেছি। তাই ভুল থাকতে পারে। কোন ভুল দেখলে দয়া করে কমেন্টে জানাবেন। আর উমরা করতে কেউ কেউ উপরের উল্লেখিত দোয়া গুলো ছাড়াও অন্যান্য দোয়া পড়ে থাকেন। ভিন্ন দোয়াও পড়েন। বেশির ভাগ আর্টিকেলে যে দোয়া গুলো পেয়েছি, আমি তাই উল্লেখ করেছি।

যতবার বাসা থেকে মসজিদে যাবেন, ততবার পারলে তাইয়্যাতুল মসজিদের দুই রাকাত নামাজ পড়ে নিবেন। এটি সুন্নত। আর মসজিদুল হারামে নামাজ পড়ার সওয়াব অনেক অনেক বেশি। উমরা করার সময় যে বার মসজিদুল হারামে ডুকবেন, তখন তাইয়্যাতুল মসজিদের নামাজ পড়তে হবে না।

মদিনা ভ্রমণ – কুবা মসজিদ ও মসজিদে নববী

মদিনায় রয়েছে মুসলমানদের প্রথম মসজিদ। এর নাম মসজিদে কুবা। হিজরতের পর মুহাম্মদ (সা) এই মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেন।

হাদিস থেকে জানা যায়, হজরত মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন, “নিজ আবাস্থল বা বাসা থেকে অজু করে কেউ যদি এই মসজিদে আসে এবং দুই রাকাত নফল নামায আদায় করে তবে সে একটি ওমরাহ আদায়ের সওয়াব লাভ করবে।”

তাই সম্ভব হলে মসজিদে কুবায় গিয়ে তাইয়্যাতুল মসজিদের দুই রাকাত নামাজ পড়ার পর দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করতে পারেন।

মসজিদে নববী হচ্ছে মহানবী (সঃ) এর মসজিদ। এর ভেতর রয়েছে মহানবী (সঃ) এর রওজা মোবারক।

এই মসজিদের ভেতর এমন একটা জায়গা রয়েছে, যাকে বলা হয় রিয়াজ উল জান্নাত বা জান্নাতের বাগান। এটা পৃথিবীতে জান্নাতের একটা অংশ। এখানে নামাজ পড়ার বিশেষ ফজিলত রয়েছে। যদিও এত বেশি ভিড় থাকে যে, সুযোগ পাওয়া যায় না। দুপুর রাত এবং সকাল ৮টার পর ভিড় একটু কম থাকে।

রাসুল ﷺ বলেছেন : আঁমার ঘর মিম্বরের মধ্যবর্তী স্থানটি জান্নাতের একটি টুকরা (রিয়াজুল জান্নাহ) এবং আঁমার মিম্বরটি আঁমার হাউজের উপর স্থাপিত”।
[সহীহ বুখারী-১১৩৮]

রওজা মোবারক দেখতে এবং জিয়ারত করতে চাইলে মসজিদের ১ নং গেট দিয়ে ঢুকতে হয়।

পুরুষেরা নামাজের কিছুক্ষণ আগে ছাড়া বাকি যে কোন সময়ই রিয়াজুল জান্নাতে গিয়ে নামাজ পড়তে পারে। তার জন্য মসজিদের দুই নং গেট দিয়ে ঢুকতে হয়। আর যারা হুইল চেয়ারে চড়ে, তারা ১ নং গেট দিয়ে ঢুকে সরাসরি কোন সিরিয়াল ছাড়াই রিয়াজুল জান্নাত এ গিয়ে নামাজ পড়তে পারে। তাদের জন্য অগ্রাদিকার দেয় আরকি।

মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট সময় রয়েছে রিয়াজুল জান্নাত এ প্রবেশ করার। ফজরের পর ৭টার দিকে, জোহরের পর এবং এশার পর রাত ৮টার থেকে রাত দেড়টা পর্যন্ত। আর তাদের প্রবেশ করতে হয় ২৫ নাম্বার গেট দিয়ে। মহিলাদের যে কোন কবরস্থানে যাওয়া এবং জিয়ারত করা নিষিদ্ধ। তবে ঘর বা পর্দার ভেতর থেকে দোয়া করা যাবে। তাই মহানবী (সঃ) এর কবর জিয়ারত ও নিষিদ্ধ। তবে মহানবী (সঃ) এর প্রতি সালাম পেশ করতে পারবেন।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে হজ্ব করার তাওফিক দান করুক। যারা হজ্ব করেছি, তাদের হজ্ব কবুল করে নিক। আমাদের সঠিক ভাবে সব আমল করার তাওফিক দান করুক। আমীন।

বিদ্রঃ ইসলামের অনেক গুরুত্বপূর্ণ টপিক্স নিয়ে লিখেছি। ভয় লাগছে যদি ভুল হয়।  লেখায় কোন ভুল পেলে সাথে সাথে কমেন্ট করে জানাবেন। আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করুক।

অনলাইনে একটু সার্চ করলেই অনেক লেখা পাবেন, এখানে কিছু লিঙ্ক যুক্ত করে দিলামঃ

এই ভিডিওটিও দেখতে পারেনঃ

Leave a Reply