রামিমকে আমি গত কয়েক মাস থেকে পড়াচ্ছি। রামিম অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে। ক্লাসের ফাস্ট বয়। আজ তাদের দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে। রেজাল্ট নিয়ে তার আব্বু আম্মু তেমন একটা খুশি নয়। কারণ প্রথম সাময়িক পরীক্ষা থেকে এই পরীক্ষায় রেজাল্ট খারাপ হয়েছে।
পরীক্ষায় রেজাল্ট খারাপ হওয়ার জন্য মনে হচ্ছে তারা আমাকেই দ্বায়ী করছে। ভেবেছে হয়তো আমার চেষ্টার কোন ভুল ছিল। কারণ কয়েক দিন পর রামিমের আম্মু এসে বলল পরবর্তী মাস থেকে আর তাকে পড়াতে আসতে হবে না।
রামিম ভালো ছাত্র হলেও বলা যায় একটু দুষ্টু। মাঝে মাঝে বলবে পড়বে না। তখন যত চেষ্টাই করা হোক না কেন, সে আর পড়বে না। আর এসব তার আম্মু আব্বুও মেনে নেয়। তাছাড়া তাদের বাসায় কম্পিউটার, প্লে স্টেশন সহ সবই আছে। পড়ালেখার সময়ই গেমস খেলে কাটায় মাঝে মাঝে। যেহেতু ফাস্ট বয়, সেহেতু তার আম্মু আব্বু এসব দিকে তেমন একটা নজর দেয় না। বাসায়, স্কুলে শিক্ষকেরা যেহেতু আছে, তাদের আর চিন্তা নেই।
পড়াতে যেতে নিষেধ করায় আমার নিজের একটু একটু মন খারাপ হয়েছে। কিছুক্ষণ পর মনে হলো একটু না, মন বেশিই খারাপ হয়েছে। আমি বসেছিলাম একটা ছাউনিতে। পাশ দিয়ে ইভান যাওয়ার সময় সালাম দিল। ইভান এবং রামিম একই ক্লাসেই পড়ে। ইভানকে গাইড করার মত বলা যায় তেমন কেউ নেই। নিজে নিজেই চেষ্টা করে পড়ে। খুব একটা খারাপ করে না। এছাড়া খুব ভদ্র একটা ছেলে বলা যায়।
ইভানকে দেখে আমার মাথায় একটা আইডিয়া আসল। পেছন থেকে তাকে ডাক দিলাম। জিজ্ঞেস করলাম তার পড়েলেখা কেমন যাচ্ছে? ইত্যাদি ইত্যাদি। এরপর বললাম পরের দিন তার সাথে বসব।
পরের দিন ইভানের সাথে তাদের বাসায় গেলাম। তার টেবিলটি কি সুন্দর করে গোছানো। সাধারণত ছেলেদের টেবিলে বই খাতা সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। তার টেবিল দেখে ভাল লাগল। কিভাবে পড়ছে, কি পড়ছে, ইত্যাদি জিজ্ঞেস করলাম। যে যে বিষয় গুলো বুঝতে অসুবিধে সেগুলো বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলাম।
এর পর থেকে মাঝে মাঝেই ইভানকে পড়া দেখিয়ে দিতে লাগলাম। আমার নিজেরও পরীক্ষা সামনে। প্রতিদিন দেখানোর সুযোগ হচ্ছিল না। কোন কিছু পড়ে সহজে বুঝার একটা পদ্ধতি ইভানকে আমি শিখিয়ে দিলাম। পদ্ধতিটিকে বলে ফাইনম্যান পদ্ধতি। নোবেল বিজয়ী পদার্থবিদ রিচার্ড ফাইম্যানের নাম থেকে নামকরণ। যা আমি একদিন পত্রিকায় পেয়েছি। এরপর নিজে নিজে মাঝে মাঝেই চেষ্টা করি এভাবে পড়ার। নিজের কাজে দিচ্ছিল। ফাইম্যান পদ্ধতি ব্যবহার করে কঠিন যে কোন বিষয় সহজে শিখে ফেলা যায়। যার ধাপ গুলো এমনঃ
প্রথম ধাপে যে টপিক্সটি শিখতে হবে, তা কোন কাগজে লিখে ফেলা। এরপর ঐ টপিক্স নিয়ে পড়া শুরু করা।
দ্বিতীয় ধাপে ঐ টপিক্স সম্পর্কে নিজের মত করে লিখে ফেলা। লিখতে হবে এমন ভাবে, যেন তুমি তোমার থেকে ছোট কাউকে শেখাচ্ছ। এভাবে লিখতে গেলে তুমি বুঝে যাবে ঐ টপিক্স সম্পর্কে তুমি কি কি ভালো করে বুঝ। আর বুঝে যাবে কি কি তুমি নিজেই বুঝ না। যে সব কিছু তুমি বুঝ না, সেগুলো মার্ক করতে হবে এরপর।
তৃতীয় ধাপে ঐ মার্ক করা বিষয় গুলো সম্পর্কে ভালো করে বুঝার চেষ্টা করতে হবে। এক্ষেত্রে বই, গাইড বা সিনিয়র কারো হেল্প নেওয়া যেতে পারে।
চতুর্থ ধাপে এসে ঐ টপিক্স নিয়ে নিজের মত করে লেখাটি পড়তে হবে। যে সব শব্দ তুমি বুঝ না, বা আরো সহজ ভাবে লেখা যায়, সেভাবে লিখে ফেলতে হবে। এভাবে করে ফেললে তুমি নিজেই দেখবে, এখন ঐ টপিক্সটি তোমার কাছে কত সহজ লাগে। আর এভাবে পড়ার চেষ্টা করলে তুমি কোন দিনও ভুলবে না। পরীক্ষায় প্রশ্ন যে ভাবেই আসুক না কেনো, তুমি উত্তর দিতে পারবে।
এভাবে আস্তে আস্তে সমাপনী পরীক্ষা চলে আসল। আর আমিও ব্যস্ত হয়ে গেলাম নিজের HSC পরীক্ষার প্রিপারেশন নিয়ে। মাঝে মাঝে ইভানের সাথে দেখা হলে জিজ্ঞেস করতাম পরীক্ষা কেমন হচ্ছে? বলত নাকি খুব ভাল। পরীক্ষা শেষে সে তার নানার বাড়িতে বেড়াতে চলে গেলো।
একদিন মসজিদ থেকে নামাজ পড়ার পর দেখা। ইভান বলল সে নাকি পরীক্ষায় সবার থেকে বেশি নাম্বার পেয়েছে। শুনে আমার কি যে ভালো লাগল। আমি তাকে নিয়ে দোকান থেকে দুইটা আইস্ক্রিম কিনে হাঁটতে হাঁটতে খেতে লাগলাম। আমার নিজের পরীক্ষার রেজাল্ট শুনেও আমার কাছে এত খুশি লাগেনি কোনদিন।
ঐদিন চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছিলাম। রামিমের আব্বুর সাথে দেখা। বলল স্যার তো মনে হয় আমাদের ভুলেই গেলেন। বাসায় এসে চা খেয়ে যান একদিন। এছাড়া রামিমের আম্মুও আপনার সাথে কি কথা বলবে বলল। আমি বললাম আসলে সামনে পরীক্ষা তো, তাই সময় হয়ে উঠে না। সময় করে একদিন যাবো।
জানি না রামিমের আম্মু কি বলবে, হয়তো বলবে রামিমকে আবার পড়ানোর। কি জানি। আমার ইভানের কথা মনে পড়ল। মনে হচ্ছিল প্রতিটা মানুষের মধ্যেই রয়েছে অসাধারণ সব সুপ্ত প্রতিভা। কেউ কেউ নিজে নিজেই ঐ প্রতিভাটাকে কাজে লাগিয়ে দারুণ কিছু করতে পারে। আর কারো কারো সাহায্যের দরকার হয়। দরকার হয় কেউ এসে তার প্রতিভাটাকে বিকশিত করতে সাহায্য করা, তাকে তার প্রতিভা সম্পর্কে জানিয়ে দেওয়া। আমি চাইছি রামিমকে ঠিক মত পড়াতে, কিন্তু হয়ে উঠে নি। হয়তো আমারই ভুল ছিল। আবার ইভানের আগ্রহও কেমন ভালো লাগত। ছোট্ট জীবনে অনেক কিছুই জানি না। তবে মনে হয় আগ্রহটাই আসল। আগ্রহটাই মানুষকে বড় করে। ইভান কি কখনো অনেক বড় হবে? কি জানি, হয়তো। হয়তো একদিন আকাশ ছুঁয়ে দিবে।