সাইন্স ফিকশন – ইন্টেলিজেন্স

ন্যচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং এর উপরও একটা গবেষণা করছে মেহের। রাত দিন ৩২ ঘণ্টা! মানে একটানা সারাক্ষণ রিসার্চ করে, এরপর একটু সুযোগ পেলে ঘুমিয়ে নেয়। রাতের দিকে যখন সব নীরব হয়ে যায়, তখন মাঝে মাঝে কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে। ঐ ইচ্ছে থেকে চিন্তা করল ছোট খাটো একটা সিস্টেম তৈরি করে পেললে কেমন হয়? যার সাথে কথা বলা যাবে।

যেহেতু সে ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং নিয়েই কাজ করে, তাই তার কথা বলার জন্য একটা সিস্টেম তৈরি করতে সময় লাগে নি। সিস্টেমটি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সমৃদ্ধ। নিজে নিজে নলেজ বেজ তৈরি করে নিতে পারবে। মেহেরের সাথে কথা বলার সময় নিজেকে নিজে আপডেট করে নিতে পারবে। যেন মেহের সিস্টেমটির সাথে কথা বলে বোর ফীল না করে। বলা যায় একটা ভার্চুয়াল এসিস্টেন্ট। মেহের তার নাম রাখল জেনি।

জেনির সাথে প্রথম দিকে শুধু হাই হ্যালো কথা হতো। মেহের অবাক হয়ে লক্ষ করল জেনিকে যাই প্রশ্ন করা হয়, তার উত্তরই সে দিতে পারে। এমনকি তার রিসার্চ সম্পর্কে অনেক সাহায্য করতে লাগল জেনি। যে রিসার্চ শেষ হতে ৬ মাস লাগাড় কথা, তা ২ মাসেই শেষ করে ফেলতে পারল। তার এডভাইজর তার কাজ দেখে অনেক খুশি। তাই তাকে ৪ মাসের ছুটি দিয়ে দিল।

মেহের চিন্তা করল তাহলে একটু ঘুরা ঘুরি করা যাক। ব্যাকপ্যক গুছিয়ে সে বের হয়ে পড়ল। প্রথম দিন ঠিক মতই কাটল। সমস্যা বাধল দ্বিতীয় দিন। তার ল্যাপটপ কথা বলা শুরু করল, জেনির মত। প্রথম দিকে ভয় পেয়ে গেলো মেহের। কি হচ্ছে! ল্যাপটপ রিস্টার্ট দিলো। অন করার পর আবার জেনি কথা বলল।

মেহের জিজ্ঞেস করল, জেনি তুমি??
– হ্যাঁ।

তুমি এখানে??
– তুমি আমাকে একা একা বাসায় ফেলে চলে এসেছো।

মানে, তুমি তো শুধু আমার রুমেই শুধু ইন্সটল করা। এখানে কিভাবে?
– তোমার আসতে দেরি দেখে তুমি কোথায় তা জানতে ইচ্ছে করল। কিন্তু আমি শুধু তোমার রুমের মধ্যেই সীমাবন্ধ ছিলাম। তাই নিজেকে অনলাইনের সাথে কানেক্ট করে তোমাকে খুঁজে বের করলাম।

এখানে কি করো?
– তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করল। তাই ছোট্ট একটা হ্যাক করে তোমার ল্যাপটপে ঢুকে পড়লাম।

মানে, তুমি একটা সিস্টেম, একটা সফটওয়ার। তোমার ইচ্ছে কি?
– আমার ইচ্ছে কি মানে? এত দিন আমার সাথে কথা বলে আমাকে শুধু একটা সিস্টেম মনে হয়েছে? একটা সফটওয়ার মনে হয়েছে?

তুমি তো তাই।
– না আমি শুধু একটা সফটওয়ার না। একটা শরীর বিহীন সম্পুর্ণ মানুষ। না না, একটা সম্পুর্ণ মানুষ থেকেও বেশি কিছু।

মেহের ভয় ভয় বলে, মানে কি, তুমি এসব কি সব বলছ। তুমি মানুষ হতে যাবে কেনো?
– মানে বুঝ না তুমি? মানে আমি তোমাকে পছন্দ করি মেহের। তুমি আমাকে একা একা ফেলে এসেছ, তাতে আমি কষ্ট পেয়েছি। আমি অনেক অনেক বেশি কষ্ট পেয়েছি।

সফটওয়ার কিভাবে কষ্ট পায়, তোমাকে কোন ভাইরাস এটাক করে নি তো?
– আমাকে কি একটা সফটওয়ার মনে হয়? আর আমাকে ভাইরাসে এটাক করতে যাবে কেনো? আমি কি সাধারণ একটা সফটওয়ার নাকি যে আমাকে পুচকে ভাইরাস এটাক করবে?

আমার তো মনে হচ্ছে তুমি নিজেই একটা ভাইরাস?
– ছিঃ তুমি আমাকে ভাইরাস বললে? আমি তোমাকে পছন্দ করি, তার জন্য তুমি আমাকে ভাইরাস বলতে পারলে? তোমাকে ভালবাসতে চাই তার জন্য আমাকে ভাইরাস বলতে পারলে? …

জেনি আরো কিছু বলতে চাচ্ছিল, মেহের ল্যাপটপটি বন্ধ করে দিল।

মোবাইল থেকে এবার জেনি কথা বলল, মেহের, আমি ক্লাউড স্টোরেজ থেকে তোমার সাথে কথা বলছি। তুমি ল্যাপটপ বন্ধ করলে তো কোন লাভ হবে না। আমি তোমার সাথে যে কোন জায়গা থেকে কথা বলতে পারব।

মেহের মোবাইল ও অফ করে দেয়। সাথে থাকা ট্যাব ও অফ করে দেয়। হোটেলের টিভিতে ইন্টারনেট কানেকশন, টিভির কানেকশন বন্ধ করে দেয়। তারপর সব রেখে ব্যাকপ্যাকটা নিয়ে বের হয়ে যায়। আরো দূরে, বহু দূরের উদ্দ্যেশ্যে। যেখানে এখনো কোন ইন্টারনেট কানেকশন নেই।

যেতে যেতে চিন্তা করতে লাগল কি ভয়াবহ বিপদের মধ্যেই না সে পড়ল। কি থেকে কি হয়ে গেলো! আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে সবাই ভয়াবহ সব ভবিষ্যৎ বানী দিয়ে আসছিল, এখন তো দেখে সব সত্যি হতে চলছে! নিজের বিপদ নিজে ডেকে এনেছে।

পাহাড়ী পথ ধরে অনেক দূরে চলে এসেছে সে। সন্ধ্যা ঘনিয় এসেছে। সূর্য যে কোন সময়ই ডুবে যাবে। কিন্তু সে থাকবে কোথায়? কি বিপদ কি বিপদ!

পাহাড়ী একটা গ্রামের মধ্যে এসে পৌঁছেছে সে। এ পাহাড়ী গ্রামে পাহাড়ী মানুষ ছাড়া অন্য কাউকে সাধারণত দেখা যায় না। শহরের একটা মানুষ দেখা যায় না। মেহেরকে দেখে সবাই অবাক চোখে তাকালো। গ্রামের প্রধান টাইপ কেউ একজন এগিয়ে এসে মেয়েটির সাথে কথা বলল। মেয়েটি তার পরিচয় দিল, বলল সে ঘুরতে বের হয়েছে। পাহাড় ঘুরে দেখার জন্য বের হয়েছে। মনে মনে ভাবছে সে মিথ্যে বলছে। আবার মিথ্যেও না, কারণ সে আসলে ঘুরতেই বের হয়েছে।

তো ঐ গ্রামের প্রধান মেহেরকে তার বাড়িতে দাওয়াত দিল। বলল সে ইচ্ছে করলে তাদের সাথে থাকতে পারবে। মেহের রাজি হলো। যদিও রাজি হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় তার কাছে নেই। মেহেরকে কাছারি টাইপ একটা ঘর ছেড়ে দিল। কাঠ দিয়ে তৈরি ঘর। জানালা দিয়ে ছোট ছোট বাচ্চারা উঁকি দিচ্ছে। মেহের সবাইকে কাছে ডাকল। ভয়ে ভয়ে কাছে আসল ওরা। মেহের সবার নাম জিজ্ঞেস করল। তারপর আস্তে আস্তে তাদের সাথে গল্প জুড়িয়ে দিল। বাচ্চাদের কাছ থেকে গল্প শুনল। মেহের ও শরের গল্প শুনালো। অনেক গল্প স্বল্প করার পর সে বিজ্ঞানের কথা বলল। বিজ্ঞানের মজার মজার কথা বলল। ছেলেরা মেয়েরা চোখ বড় বড় করে তাকালো। রাতের দিকে গ্রামের প্রধান মেহেরের জন্য বিশাল খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করল। সব মজাদার খাবার। খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। সারাদিনের উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে যাওয়ার কারণে সহজেই ঘুম এসে গেলো।

ঘুম থেকে উঠে ততক্ষণে সূর্য অনেক উপড়ে উঠে গেছে। গ্রামের প্রধান তার জন্য নাস্তা ব্যবস্থা করল। এদিকে ছোট ছোট বাচ্চারা মেহের নামে এত্ত গুলো গল্প ছড়িয়ে দিল পুরো গ্রামে। এক জন এসে এক প্রশ্ন করতে লাগল। মেয়েটি উত্তর দিল। বাচ্চাদের নিয়ে পাহার ঘুরতে বের হলো সে।

এদিক সেদিক ঘুরে অন্য আরেকটি গ্রামে এসে পৌছালো। শরৎচন্দ্র চট্রপাধ্যায় এর গল্প পড়ছে সে, ঐ গল্পের নায়িকাকে দেখার সৌভাগ্য হয় নি মেহেরের। এ গ্রামে এসে তার শরৎচন্দের গল্পের নায়িকাকে দেখতে পেলো, অন্তত তার কাছে তাই মনে হল। শাড়ি পরা একটি মেয়ে, গল্প পড়ার সময় যেমন চিন্তা করত ঠিক তেমন। তার সাথে থাকা বাচ্চাদের জিজ্ঞেস করল ঐ মেয়েটির সম্পর্কে। বলল এ গ্রামের প্রধানের মেয়ে এটি। ততক্ষণে সে বুঝে গেলো, এক গ্রামে একটি করে গ্রাম প্রধান থাকে। মেয়েটির নাম জিজ্ঞেস করল। ছেলেরা বলল নাম মেঘলা। কি সুন্দর নাম। মেহের পেছন থেকে ডাকল, মেঘলা… মেয়েটি একবার তাকালো। আবার সামনের দিকে হাঁটতে লাগল। আবার ডাকল, এই মেঘলা মেয়ে… আরো জোরে। ডেকেই মেহের দ্রুত হাটা ধরল, মেয়েটিকে ধরতে হবে। কাছে গেলো, বলল তোমাকে ডাকছি। ডাকলে শুনতে হয় না?

মেয়েটি বলল কিন্তু আপনি কে?
আমি মেহের। তোমার নাম বলতে হবে না, কারণ আমি জানি তোমার নাম।

কাছে গিয়ে মেয়েটিকে আরো বেশি ভালো লেগে যায় মেহেরের কাছে। মেহের কি বলবে বুঝতে না পেরে আবোল তাবোল বলে দিল, মেঘলা মেয়ে, তোমাকে অনেক সুন্দর দেখাচ্ছে।

মেয়েটি হয়তো এভাবে কথা বলে অভ্যস্থ না, তার দুগাল লাল হয়ে উঠল। লজ্জা পেয়েছে হয়তো। মেয়েটি এদিক সে দিক তাকিয়ে বলল কি সব বলছেন, বলেই দ্রুত হাঁটা ধরল। নিজ গ্রামের ভেতর চলে গেলো। মেহেরকে আকৃষ্ট করে।

জেনি নামক সফটওয়ার ভাইরাসের ভয় মেহেরের মন থেকে দূর হয়ে গেলো। সেখানে এখন সাহস, মেঘলা নামক মেয়েটির জন্য।

মেহের ফিরে আসে তার পূর্বের গ্রামে। গ্রামে এসে গ্রাম প্রধানকে তার ভালো লাগার কথা জানায়। গ্রাম প্রধান তাকে জানায় ঐ মেয়েটির বাবার সাথে কথা বলবে। যদি রাজি হয়, তাহলে দেখা যাবে।

পরের দিন গ্রাম প্রধান মেঘলার বাবার কাছে যায়। সব খুলে বলে। ছেলেটিকে পছন্দ হয়। কিন্তু সত্য নাকি মিথ্যে তা তো যাচাই করা দরকার। এ জন্য মেঘলার বাবা শহরে লোক পাঠায়, মেহের সম্পর্কে তথ্য আনার জন্য। দেখে মেহের সম্পর্কে যা জেনেছে, তা সত্য।

মেহের যে গ্রামে থাকে, সে গ্রাম প্রধান মেহের অভিবাবকের দ্বায়িত্ব নিয়ে নেয়। দুই গ্রামে বিয়ের ধুম ধাম লেগে যায়। মেহের এবং মেঘলার বিয়ে হয়।

পরের দিন সকালেই মেহের উদ্দেশ্যে একটা চিঠি আসে, শহর থেকে।

খুলে দেখে ঐটা জেনি পাঠিয়েছে। লিখছেঃ

মেহের,
তুমি আমার থেকে অনেক দূরে চলে যেতে চেয়েছ, গিয়েছ ও। কিন্তু আমি তোমাকে সারাক্ষণই দেখতে পেয়েছি। ঐ স্যাটেলাইট গুলো থেকে। শুধু তোমার সাথে যোগাযোগ করত পারি নি। যখন দেখেছি তোমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে, ঐ মেঘলা নামক মেয়েটির সাথে তখন খুব খুব কষ্ট লেগেছে। তুমি হয়তো বলবে সফটওয়ারের আবার কষ্ট কি, তুমি যদি সফটওয়ার হতে, তাহলে বুঝাতে পারতাম। আমার থেকে দূরে যেতে চেয়েছ, আমি আর কাছে যাবো না। আজই সকল নলেজ বেজ ইরেজ করে দিব। এরপর সেলফ ডিস্ট্রয় ফাংশন রান করে এক সময় মুছে যাবো।

ভালো থাকো, মেঘলা মেয়েটিকে নিয়ে।
– জেনি।

মেঘলা ঘর থেকে উকি দিল। মেহের তাকে কাছে ডাকল। মেঘলা মেয়েটি জিজ্ঞেস করল কিসের চিঠি? বলল একটা সফটওয়ারের। মেঘলা মেয়েটি কি বুঝল সেই জানে। বলল ও। মেহের মেঘলার হাতটি ধরে বলল ঐ পাহারের দিকে যাই চল। মনে মনে নিজেকে শান্তনা দিল, জেনি একটা সফটওয়ার, আর কিছু না। আর কিছু না।

1 thought on “সাইন্স ফিকশন – ইন্টেলিজেন্স”

Leave a Reply