উগ্রতা এবং সাম্প্রদায়িকতা

উগ্রতা এবং সাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কে আমাদের কিছু ভুল ধারণা রয়েছে। ধর্ম পালন হিন্দুরা যেমন করে, খ্রিষ্টানরা যেমন করে, বৌদ্ধরা যেমন করে, মুসলমানরাও তেমন করে। নির্দিষ্ট সময়ে নিজেদের ধর্ম পালন করে। অন্য কোন ধর্মের কেউ পরিপূর্ণ ভাবে তার ধর্ম পালন করলে আমরা তাকে সাম্প্রদায়িক বলি না, তাকে উগ্রতা ট্যাগ দেই না। শুধু মাত্র মুসলমানদের দেই। ইসলাম পালন করলেই তাকে উগ্রতা বা সাম্প্রদায়িক ট্যাগ দেই।

অনেকে এই সাম্প্রদায়িক জিনিসটাই বুঝে না। উইকিপিডিয়া থেকেঃ ‘সম্প্রদায় হল ক্ষুদ্র বা বৃহৎ জনগোষ্ঠী যাদের মধ্যে কিছু বিষয়, যেমন সামাজিক প্রথা, ধর্ম, মূল্যবোধ, ও পরিচয়ের মিল থাকে’। আমরা সবাই কোন না কোন সম্প্রদায়ের অংশ। মুসলমান সম্প্রদায়, হিন্দু সম্প্রদায়, বাঙ্গালী সম্প্রদায় ইত্যাদি। তো যে কেউই তার নিজের সম্প্রদায়ের এই সব আচার বা সামাজিক প্রথা পালন করার অধিকার রাখে।

আমি যেহেতু এক বা একাধিক সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত (দেশ হিসেবে, ধর্ম হিসেবে, জাতি হিসেবে), আমাকে আমার সম্প্রদায়ের আচার আচরণ মেনে চলতে হবে। আচার আচরণ মেনে চললে আমি উগ্র হয়ে যাই না। উল্টো একজন বেটার সিটিজেন হয়ে উঠি (সাম্প্রদায়িক হই)। আমরা বাঙ্গালী হিসেবে কিছু আচার আচরণ মেনে চলি। আবার বাংলাদেশী হিসেবেও কিছু আচার আচরণ মেনে চলতে হয়। যদি বাংলাদেশের আচার আচরণ মেনে না চলি, তাহলে উল্টো সমস্যা। দেখেন, সাম্প্রদায়িকতা খারাপ জিনিস না। ভালো জিনিস। ভালো ট্যাগ। আমরা খারাপ ভাবে ব্যবহার করি।

এখন কিছু মানুষ মনে করে যে ধর্ম পালন করলেই, স্পেশালি ইসলাম ধর্ম পালন করলে আমি সাম্প্রদায়িক, একটা খারাপ ট্যাগ হিসেবে এই শব্দটা ব্যবহার করে। এতটুকু ভাবার অবকাশ হয় নাই যে সাম্প্রদায়িকতা খারাপ জিনিস না। নিজ নিজ সম্প্রদায়ের নিয়ম কানুন মেনে চলার পরিপূর্ণ স্বাধীনতা সবার আছে।

এবার আসি উগ্রতায়। এতক্ষণ এত কিছু লেখার কারণ হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা এবং উগ্রতা যে এক না, তা পরিষ্কার করা। যেটাকে আমরা গুলিয়ে ফেলি। কেউ যদি এক্সট্রিম কিছু করে বসে, তাহলেই তা উগ্রতা। এক্সট্রিম কেমন হতে পারে? নিজের মত অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করা, নিজ সম্প্রদায়ের দোহাই দিয়ে অন্য সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণ করা সহ আরো নানা বিষয়। যে সব বিষয় আমরা এতদিনে কিছুটা অবগত।

দেখেন, উগ্রতা সবাই করে না। গুটি কয়েক মানুষ করে। কিন্তু এই গুটি কয়েক মানুষের জন্য পুরো একটা গোষ্টিকে আমরা উগ্র ট্যাগ দেই। সারা বিশ্বই এই ট্রেন্ডে চলছে। কোন একজন মুসলমান যদি কোন খারাপ কাজ করে থাকে, আমরা পুরো ধর্মকে টেনে আনি। মানুষ মাত্রই অনেক গুলো দোষের সমষ্টি। অন্য সব ধর্মের মানুষ যেমন দোষ করে বা করতে পারে, ইসলাম যারা পালন করে, তারাও দোষ করে বা করতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অন্য ধর্মের কেউ দোষ করলে ঐ নির্দিষ্ট ব্যাক্তিকে দোষারপ করা হয়। ইসলামের ক্ষেত্রে উল্টোটা। কেউ একজন দোষ করলে পুরো জাতিকে দোষী বানিয়ে দেয়। এক জনের দোষ দিয়ে পুরো মুসলমান সম্প্রদায়কে বিচার করে ফেলে।

মিডিয়া এবং ইনফ্লুয়েন্সাররা এই জায়গায় অনেক সফল। আমাদের মনে এমন ভাবে ইসলাম এবং উগ্রতা ঢুকাতে ফেরেছে যে আমরা ধরেই নিচ্ছি যে ইসলাম যে পালন করে, সেই উগ্র। ইসলাম এবং উগ্রতা সমর্থক শব্দ। সাধারণ একজন মুসলমান যখন পরিপূর্ণ ধর্ম পালন করার চেষ্টা করে, তা অনেকের কাছে উগ্রতার সমান। মানে ইসলাম পালন করা অনেকের কাছে উগ্রতা। অথবা এমন ভাবে চিন্তা করে যে, যে ইসলাম ধর্ম পালন করবে, সেই উগ্র।

এই রকম জেনারালাইজ করে হয়তো যারা ইসলাম মানে, তাদের কিছুটা ক্ষতি হয়।

তাদের কিছু কিছু ক্ষেত্রে অপ্রীতিকর ঘটনার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে চিন্তা করলে এই রকম জেনারালাইজ করা সবার জন্যই ক্ষতিকর। যারা ইসলাম মানে এবং যারা মানে না, সবাই এই সমাজের অংশ। একটা অংশকে ছাড়া আরেকটা অংশ আসলে টিকতে পারে না। একটা বাস্তুসংস্থানের ক্ষুদ্র একটা কিটও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তো দেশ নামক বাস্তুসংস্থানে প্র্যাকটিসিং মুসলমানরাও একটা অংশ। এদের কেউ আমাদের ভাই, কেউ চাচা, কেউ মামা, কেউ দূর সম্পর্কের আত্মীয়। হয়তো চিন্তা করেন এরা না থাকলেই বাঁচি। কিন্তু না, কোন না কোন ভাবে এরা আপনার কাজে আসছে, বুঝতেও পারেন না। যেমন অক্সিজেন যে একটা দামি বস্তু, যখন কিনতে হয় তখনই বুঝা যায়। তেমন আরকি।

যে অন্যায় করে, সে ধর্ম মেনে অন্যায় করে না। কোন ধর্মই অন্যায় শিখিয়ে দেয় না। অন্যায় করা মানুষের প্রবৃত্তির অংশ। ইসলাম ধর্মও উগ্রতা দেখাতে বলে না। এমনকি উগ্রতা সমর্থনও করে না। যারা উগ্রতা পছন্দ করে, তারা মুসলিম দলভুক্তও না। এরপর থেকে কেউ অন্যায় করলে তাকেই বিচার করার চেষ্টা কইরেন। পুরো সম্প্রদায়কে টেনে আনার অধিকারটুকু আপনার নেই।

আমি অন্যায় করলে আমাকে এজ এ পারসন হিসেবে বিচার কইরেন। কোন ধর্ম পালন করি, কোন দেশের, কোন জাতির এত সব দেখে বিচার করলে আমার দেশ, জাতি, ধর্মের প্রতি অবিচারই হবে। সঠিক বিচারটুকু করার জ্ঞানটুকু রাইখেন। দয়া করে রেসিজম কইরেন না। আমার দেশ যেমন আমাকে কিভাবে চলতে হবে, তার একটা গাইডলাইন দিয়ে দিয়েছে, যাকে আমরা সংবিধান বলি। এর বাহিরে গেলে আমি অপরাধী হিসেবে গণ্য হই। দেশের কেউ অপরাধ করলে পুরো দেশের সবাইকে অপরাধী বানান আপনারা? বলেন যে বাংলাদেশের সবাই উগ্র? বলেন না। একই ভাবে আমার ধর্মও আমাকে কিভাবে চলতে হবে, তার একটা গাইডলাইন দিয়ে দিয়েছে। যদি ধর্মের বাহিরে কোন অধর্ম করি, এক মাত্র আমিই অপরাধী। আমার ধর্মের সবাই না।

1 thought on “উগ্রতা এবং সাম্প্রদায়িকতা”

Leave a Reply