নিঝুম দ্বীপ এর আগে এসেছি ২০১৪তে। বর্ষাকালে। তা সম্পর্কে জানা যাবে এখান থেকে। এবার এসেছি শীতের শেষ দিকে। আমরা এক সাথে অনেক জন এসেছি। ১৭ জনের মত। সব কিছু আয়োজন করেছে আপন ভাই। সাথে ছিল আল-আমিন ভাই, জসীম ভাই, মাহাবুব ভাই, সুভাস ভাই, সাইফুল, ফয়সাল, মাহাবুব ভাই, অনিক ভাই, সহ আরো অনেকে।
নিঝুম দ্বীপ আসার জন্য সবাই মিলিত হয়েছি সদর ঘাটে, ৩ টার দিকে, শুক্রবার ১৯ তারিখ। লঞ্চে করে রওনা দিয়েছি। লঞ্চ ছেড়েছে সাড়ে পাঁচটার দিকে। বলতে গেলে অনেক আগেই আমরা এসেছি সদর ঘাট।
লঞ্চে করে যাওয়া আগেই ঠিক ছিল। আপন ভাই আগেই জিজ্ঞেস করল আমাদের কেবিন লাগবে কিনা। আমরা বলছি সবাই যেভাবে যাবে, সে ভাবে যাবো। তো ভেবেছি লঞ্চে কেবিন ছাড়াও হয়তো সিট থাকবে। জানতাম না কেবিন ছাড়া লঞ্চে আসতে হলে ডেকে বসে আসতে হবে। আমাদের সাথে একটা ফ্যামিলি ছিল। কেবিন নেওয়া হয়েছে তিনটা, ঐ তিনটা কেবিন ঐ ফ্যামিলিকে দেয়া হয়েছে। আর আমরা বাকিরা সবাই ডেকে করে এসেছি। লঞ্চ ছাড়তে ছাড়তে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। আমরা কিছুক্ষণ হাঁটা হাঁটি করে ডেকে এসে বসে বসে গল্প করেছি। কেউ কেউ কার্ড খেলল। আর যখন একটু ঘুম পাচ্ছিল, ডেকে অন্য সব মানুষের মত লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছি। লঞ্চের উচ্চ শব্দের মধ্যে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে, কিছুক্ষণ জেগে এসে হাতিয়া পৌছালাম। রাতের খাবার খেয়েছি লঞ্চে।
হাতিয়া পৌঁছেছি সকাল ৮টার দিকে। লঞ্চ ভ্রমণে একটা সুবিধে হচ্ছে টায়ার্ড লাগে না। সুন্দর ভাবেই আমরা এসে পৌঁছিয়েছি। লঞ্চ থেকে আমাদের নামতে হয় নি। লঞ্চের পাশেই ছিল হাতিয়া থেকে নিঝুম দ্বীপ যাওয়ার ট্রলার। ট্রলারে উঠে পড়লাম। নিঝুম দ্বীপের উদ্দেশ্যে। আমাদের সাথে ট্রলারে ছিল তাবলীগের একটা দল। হাতিয়া থেকে নিঝুম দ্বীপের দিকে এসেছি আমরা বাতাস এবং জোয়ারের বিপরীতে। তাই অনেক সময় লেগেছে। প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা লেগেছে যেতে। ট্রলারে ছিল অনেক রোদ। বাতাস অনেক থাকায় তেমন গরম লাগে নি।
নিঝুম দ্বীপ যেতে যেতে সাড়ে এগারোটার মত ভেজে গেলো। এখানে এসে হোটেলে উঠেছি। এখানে প্রথম বার যখন এসেছি, তখন শুধু ছিল নিঝুম রিসোর্ট। এখন নতুন হয়েছে হোটেল শাহিন। অনেক বেশি ট্যুরিস্ট থাকায় আমাদের সবার হোটেলে জায়গা হয় নি। হোটেলে তিনরুম নিয়েছিল। বাকিরা থেকেছি হোটেলের মালিকে বাড়িতে।
বাড়ির পাশেই ছিল একটা পুকুর। গোসল করতে চলে গেলাম পুকুরে। পুকুর পাড়ে ছিল ডাব গাছ। হাত দিয়েই ধরা যাচ্ছে। খেতে ইচ্ছে করল। ডাব গাছের মালিকের সাথে কথা বলে আমরা ডাব পেড়ে খেলাম। এরপর গোসল করলাম। গোসল করে সবাই মিলে রেডি হতে হতে ১টা ভেজে গেলো। সকালে খেয়েছি ব্রেড, জেলি, কলা আর আপেল। অনেক ক্ষুদা লেগে গিয়েছে। খাবার খেতে যেতে হয়েছে এখানের এক হাজী সাহেবের বাড়ি। হোটেলের লোক বলল হেঁটে যেতে ১০ মিনিট লাগবে। ৩০ মিনিট হেঁটেও হাজী সাহেবের বাড়ি যেতে পারলাম না। পরে নসিমন নামে এক ধরণের বাহনে উঠে ঐখানে পৌছালাম।
হাজী সাব আমাদের জন্য যে আয়োজন করেছে, তা দেখে সব কষ্ট ভুলে গিয়েছি আমরা সবাই। ভর্তা, ইলিশ ভাজি আর রাজহাঁস। খাবারের টেস্ট ছিল অতুলনীয়। খাবার খাওয়ার পর বাড়ির আঙ্গিনায় বসেছি কিছুক্ষণ। বসে বসে হাওয়া খেয়েছি। খাওয়ার পর একটু রেস্ট নেওয়া। হাজী সাহেবের বাড়ির ছোট ছোট নারিকেল গাছে অনেক ডাব ধরেছে। ডাব দেখে খেতে ইচ্ছে করল। আমরা কিছুক্ষণ পর ডাব পেড়ে খেলাম। এরপর চলে গেলাম হরিণ দেখতে।
হরিণ দেখতে হয় খুব সতর্ক ভাবে। হরিণ যদি বুঝতে আসে পাসে কেউ আছে, তাহলে হরিণ পালিয়ে যাবে। আর হরিণ দেখা যাবে না। হরিণ অনেক লজ্জাবতী সম্ভবত। কাউকে দেখলেই লজ্জা পায়। আমাদের সাথে অনেক বেশি লোক থাকায় আমরা দুই গ্রুপ হয়ে গিয়েছি। ফ্যামিলি মেম্বাররা এক গ্রুপে। অন্যরা অন্য গ্রুপে।
প্রায় ২০ মিনিট হাঁটার পর আমাদের সাথের কয়েক জন মাত্র এক পলকের জন্য একটি হরিণ দেখতে পেয়েছে। যখনি যারা পেছনে ছিল, তাদের ডাকতে গেলো, তখনি ঐ হরিণটি চলে গেলো। হাঁটতে হয় ম্যানগ্রোভ বনের ভেতর। সুন্দরী গাছের শ্বাস মূল খাড়া হয়ে থাকে। হাঁটা কষ্ট কর। তার উপর আমার পায়ে আগে থেকেই ব্যথা। তাপররও হরিণ দেখার জন্য হাঁটছি। অনেকক্ষণ হেঁটেও যখন আর হরিণ দেখতে পারি নি, তখন সবাই মিলে চিন্তা করলাম ফিরে যাবো। কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে আমরা ফিরে যাচ্ছি। ফিরে যাওয়ার পথে অনেকক্ষণ পর অনেক গুলো হরিণ দেখতে পেলাম। ওরা ম্যানগ্রোভ বনের ভেতর ছোট্ট একটা মাঠে শুয়ে ছিল। আমাদের শব্দ শুনেই দাঁড়িয়ে গেলো। তখনো আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। যখনি বুঝতে পারল কেউ আসছে, তারা তখনি দিল দৌঁড়। যদিও এবার সবাই হরিণ দেখতে পেরেছে।
ফিরে গেলাম হোটেলে। ফিরতে ফিরতে তখন সন্ধ্যা হয়ে গেলো। কিছুক্ষণের জন্য ঐখানের সমুদ্র সৈকতে চলে গেলাম। একটু হাঁটা হাঁটি করে রুমে ফিরলাম। এত বেশি টায়ার্ড ছিলাম যে বিছানায় হেলান দেওয়ার সাথে সাথেই ঘুম চলে এসেছে। ৮টার দিকে জাগিয়ে তুলল। খেতে যেতে হবে। আবার হাজী সাহেবের বাড়ি। নসিমনে করে হাজী সাহেবের বাড়ি গেলাম। আমাদের জন্য মুরগি খিচুড়ি আর ডিম ভাজি করে রেখেছে। খেয়ে নিলাম। খেয়ে কিছুক্ষণ রেস্ট নিলাম। এরপর আমাদের জন্য নিয়ে এসেছে রস। খেঁজুরের রস। খেয়ে নিলাম। বার-বি-কিউ করার জন্য মুরগিতে মসলা দিয়ে দিল আমাদের। ঐ গুলো নিয়ে ফিরলাম হোটেলের কাছে। আমরা যে বাড়িতে উঠেছি, ঐটার পাশেই ছিল একটা মাঠ।
মাঠে গিয়ে ক্যাম্প ফায়ার করলাম। ঐখানে ফানুস উড়ালাম। এবং ক্যাম্প ফায়ারের কয়লাতে বার-বি-কিউ তৈরি করল। তৈরি করার পর সবাই মিলে খেলাম। এসব করতে করতে প্রায় ১২টা ভেজে গেলো। সবাই টায়ার্ড থাকায় অনেকেই হোটেলে বা বাড়িতে ফিরে গেলো। আমরা কয়েক জন থেকে গেলাম। আকাশে সুন্দর একটা চাঁদ। ঐ চাঁদনি রাতে সৈকতের দিকে চলে গেলাম। সাথে নিয়ে গেলাম আরো কিছু ফানুস। সৈকতে গিয়ে মন ভরে গেলো। এত সুন্দর ভিউ। আকাশে পূর্ণ চাঁদ থাকায় সব কিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। কি সুন্দর বাতাস বইছিল। আমরা বীচে অনেকক্ষণ বসে ছিলাম। বসে থাকতেই ভালো লাগছিল।
বীচ থেকে কিছুদূর এসে বাকি ফানুস গুলো উড়ালাম। এরপর বাড়ির দিকে ফিরলাম। আপন ভাই টেন্ট নিয়ে গেলো। ক্যাম্প ফায়ারের পাশেই টেন্ট পেতেছিল। আমি ভাবলাম টেন্ট এ থাকব। দুই জনের টেন্ট হওয়াতে আমার সাথে থেকেছে অনিক ভাই। দারুণ লেগেছে।
ঘুম ভেঙ্গেছে সকালে। টেন্ট থেকে বের হয়ে ফ্রেস হলাম। যে বাড়িতে থেকেছি, তাদের নারিকেল গাছ থেকে ডাব পেড়ে নিলাম। ছোট ছোট গাছ। হাত দিয়েই পাড়া যাচ্ছিল।
সবাই রেডি হলে নাস্তা করতে গেলাম। নাস্তা করে কথা ছিল সাইকেল চালানোর। কিন্তু পর্যাপ্ত সাইকেল না থাকায় আমাদের আর সাইকেল চালানো হয় নি। আমরা মোটর সাইকেলে করে দ্বীপের অন্য পাশের বীচে চলে গেলাম। সকাল বেলায় তখনো কুয়াশা ছিল। সমুদ্রের পাড়ের কুয়াশা গুলো গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির মত। ভালো লাগতেছিল। বীচের পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমরা হোটেলের কাছা কাছি চলে এসেছি। এভাবে প্রায় ১১টা ভেজে গেলো। তারপর রুমে ফিরে ফ্রেস হয়ে নিলাম। আমরা যে বাড়িতে থেকেছি, এখানে এক জনের বাড়িতে পেয়ারা গাছ ছিল। পেয়ারা পেড়ে খেলাম আমরা। সব কিছুই কমার্শিয়াল। টাকার বিনিময়ে। এরপর চলে গেলাম আবার হাজী সাহেবের বাড়ি। ব্যাগ গুছিয়ে সাথে নিলাম। কারণ নিঝুম দ্বীপকে বিদায় জানাতে হবে।
হাজী সাব আমাদের জন্য এবার রান্না করেছে মুরগি, মাছ ভাজি আর চিংড়ি পাতুড়ি। সাথে ছিল ডাল আর ভর্তা। ভালো লেগেছে। ঐ গুলো খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে চলে গেলাম ঘাটে। ট্রয়ালে করে যেতে হবে হাতিয়া। হাতিয়া গিয়ে অন্য পাশের ঘাটে এসেছি জিফে করে। প্রায় ২ ঘণ্টা লেগেছে আসতে। সেখান থেকে ট্রলারে করে এসেছি মূল ভু খণ্ডে, নোয়াখালীতে। ট্রলারে যতক্ষণ ছিলাম, চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশ দেখতে দেখতে ফিরেছি।
যখন নোয়াখালী এসেছি, তখন রাত ৮টা ভেজে গেলো। তারপর বাসে উঠে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। যাতায়াত ব্যবস্থা অনেক খারাপ। খারাপ হলেও এডভ্যান্সার রয়েছে। ট্রলারে করে এক পাড় থেকে অন্য পাড়ে যাওয়া অনেক রিক্স। ডেউ বেশি হলে ট্রলার একবার এ কাত হয়, আরেকবার অন্য কাত। তখন কেমন ভয় ভয় করে। এই বুঝি ঢুবে গেলো। এগুলো ভালো লেগেছে।
নিঝুম দ্বীপ জায়গাটা সুন্দর। একই সাথে অনেক ধরণের ফীল। ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট, হরিণ দেখা, আর সমুদ্র সৈকত। এখানে আসতে হয় শীত কালে। এর আগে আমরা এসেছিলাম বর্ষা কালে। তখন সব পানিতে পূর্ণ থাকে। তাই সব দিকে যাওয়া যায় না। শীত কালে পানি না থাকায় সব দিকে যাওয়া যায়। সব কিছু সুন্দর ভাবে উপভোগ করা যায়। সুন্দর কিছু অনুভতূতি নিয়ে ফিরে আসলাম আপন নীড়ে।
দারুণ লেগেছে তবে প্রতিবারের মত খরচ গুলা উল্লেখ করলে ভাল হত
আমাদের জন প্রতি ৪৩০০ টাকা খরচ হয়েছে। ঢাকা থেকে আসা যাওয়ার খরচ সহ 🙂
ক্যাম্পিং করলে যদি কোন রিসোর্ট বুকিং না দেই , সেইক্ষেত্রে দুই দিন চট্বগ্রাম থেকে থাকা খাওয়া সহ নিঝুম দ্বীপ ঘুরে আসা যাবে জনপ্রতি ২৫০০০-৩০০০ করে বাজেট করলে । ১৫-২০ জনের গ্রুপ। ভার্জিন আইল্যান্ড যেতে-আসতে খরচ কত পড়বে এই সাইজের একটা গ্রুপের আনুমানিক, খরচ গুলো মেনশন করলে উপকৃত হতাম । 🙂
জনপ্রতি ২৫০০-৩০০০ বাজেট করলে কি হবে ? *
নিঝুম দ্বীপ থেকে ভার্জিন আইল্যান্ড যাওয়া আসা খরচ কত ? *
খুব সুন্দর !