বিকেলে শুভ ভাইয়া যখন সবাইকে মহাকাশ, মহাবিশ্ব বা বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বলত সবাই হাসত। পেছনে পেছনে ওরা বলত শুভ ভাইয়ার মাথায় সমস্যা আছে। মাঝে মাঝে যখন ছোট ছেলেমেয়েরা না বুঝেই উলটা পালটা প্রশ্ন করত প্রায় সময়ই তিনি উত্তর দিতে পারতেন না। তখন উনার মুখ লাল হয়ে যেতো। কিভাবে বুঝাবে চিন্তা করতে করতে বলত আচ্ছা, এটা সম্পর্কে আগামী কাল বলি? পরের দিন এসে শুভ ভাইয়া ঐ বিষয়টিকে সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে দিত। যদি ভুল প্রশ্ন হয় তাহলে তাও বলত কেন ভুল।
শুভ ভাইয়া ক্রিকেট খেলতে গেলেও সবাই হাসাহাসি করত। কি অদ্ভুত ভাবেই না ব্যাটটি ধরতেন তিনি। অথচ তিনি ভালো রান নিতে পারতেন। ঐ অদ্ভুত ভাবেই তিনি চার বা ছয় মারতে পারতেন।
শুভ ভাইয়ার বিজ্ঞান নিয়ে কথা গুলো অনেকেই বিশ্বাস করতে চাইতো না। অথচ আমি যত শুনতাম ততই শুনতে ইচ্ছে করত। সন্ধ্যা হলে সবাই চলে গেলেও আমি যেতাম না। শুভ ভাইয়ার সাথে বসে থাকতাম। শুভ ভাইয়া সন্ধ্যার সময় উদাস হয়ে মাঠের কোনায় বসে থাকত। আর সূর্য ডোবা দেখত। দেখত বাদুর উড়ে যাওয়ার দৃশ্য। ঐ সময় শুভ ভাইয়া অনেক কথা বলতেন। অনেক কিছুই আমি বুঝতাম না। তারপর ও বুঝার ভান করে আরো শুনতাম।
শুভ ভাইয়ার সাথে থাকতে থাকতে বুঝতে পারতাম শুভ ভাইয়া রাত্রি আপুকে পছন্দ করে। কারন রাত্রি আপুকে দেখলে শুভ ভাইয়া কেমন লজ্জা পেত। উনার মুখ তখনো লাল হয়ে যেতো। উনার কথা তখন উলটা পালটা হয়ে যেতো। যখন বুঝতে পারতেন তিনি উলটা পালটা বলছেন তখন দ্বিতীয় বারের মর লজ্জিত হতেন।
শুভ ভাইয়া রাত্রি আপুকে পছন্দ করলেও রাত্রি আপু করতেন না। রাত্রি আপু পছন্দ করতেন অমিত ভাইয়াকে। অমিত ভাইয়া ছিল উনাদের ক্লাসের ফাস্ট বয়। আমি বুঝতাম না মেয়েরা কেন সব সময় ফাস্টবয় দেরই পছন্দ করে। যেমন ইফতি। আমি প্রতিদিনই আশা করতাম ইফতি আমার সাথে বসবে, আমার সাথে কথা বলবে। কিন্তু না। প্রতিদিনই আমাদের ক্লাসের ফাস্টবয়ের সাথে বসত। আমার তখন কষ্ট লাগত। তখন মনে হতো আমিও ফাস্ট বয় হবো। সব কিছু পড়ে মুখস্ত করে ফেলব। তখন হয়তো ইফতি আমার সাথে বসবে।।
বিকেল বেলায় সুযোগ ফেলে আমি তা শুভ ভাইয়াকে জানাতাম। শুভ ভাইয়া সব কিছু শুনে বলত পড়ালেখা মানে ফাস্ট বয় হওয়া বা মুখস্ত করা না। পড়ালেখা মানে হচ্ছে জানা। অনেক কিছু জানা। মহা বিশ্বের তুলনায় আমরা কত ক্ষুদ্র তা জানা। আবার ক্ষুদ্র এই আমাদের ডিএনএ তে কত তথ্য রয়েছে সেসব সম্পর্কেও জানা। চিন্তা করতে পারা। চিন্তা করে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে পারা। মুখস্ত করে হয়তো তুমি পরীক্ষায় অনেক গুলো নাম্বার পাবে, তাতে কি হবে? কি হবে জেনে কোন দেশের মুদ্রার কি নাম? বা কোন দেশের রাজধানীর কি নাম? এগুলো তো বই দেখে সহজেই বলে দেওয়া যায়।
মুখস্ত করতে আমার ভালো লাগত না। তাই এসব শুনে মনে মনে খুশি হতাম। আবার বাসায় গেলে বাবা মায়ের বকাও শুনতে হতো মাঝে মাঝে। পরীক্ষায় খারাপ করলে যারা ভালো করে, তাদের কথা বলে বকার পরিমান বাড়িয়ে দিত। তখন শুভ ভাইয়া যে সব কথা বলত, মনে মনে সেগুলো ভাবতাম। আর ভাবতাম একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। একদিন আমি অনেক ভালো করব। সবার থেকে ভালো।
শুভ ভাইয়ার বাসায়ও মাঝে মাঝে উনাকে বকা দিত। উনাকে বকা দিলে উনার থেকে আমার বেশি খারাপ লাগত। তখন আমি আর শুভ ভাইয়া পুকুর পাড়ে চলে যেতাম। বসে বসে পুকুরে ঢিল ছুড়তাম।
শুভ ভাইয়া লেখালেখি করত। বেশির ভাগই বিজ্ঞান নিয়ে। উনার লেখা অনেকেই পছন্দ করত। মাঝে মাঝে উনার কাছে দূর থেকে ছেলে মেয়েরা আসত দেখা করতে। উনারা তখন বিজ্ঞান নিয়ে অনেক আলোচনা করতেন। আমি এক পাশে বসে বসে শুনতাম। অনেক কিছুই বুঝতাম না। তারপরও শুনতে ভালো লাগত। শুভ ভাইয়ার সব কথাই আমার ভালো লাগে।
রাত্রি আপুরা মনে করত শুভ ভাইয়ারা উলটা পালটা আড্ডা মারে। তাই শুভ ভাইয়াদের কোন দামই দিত না। রাত্রি আপু, অমিত ভাইয়ারা যখন ক্লাসের এসাইনমেন্ট আর ক্লাসটেস্ট নিয়ে আলোচনা করত, শুভ ভাইয়া তখন কসমলজি , আপেক্ষিক তত্ত্ব বা রোবটেরা সামনে কিভাবে মানুষদের উপকার করবে আর কিভাবে ক্ষতি করবে ইত্যাদি সহ নানা বিষয় নিয়ে কথা বার্তা বলতেন। উনারা অনেক বই নিয়ে আসতেন আশার সময়। আবার শুভ ভাইয়ার থেকেও বই নিয়ে যেতেন।
শুভ ভাইয়া নাকি বই কিনতে চাইলে উনাকে টাকা দিতেন না উনার আব্বু। বলতেন পরীক্ষায় খারাপ করে বই কিনে লাভ কি হবে? কি হবে এসব আউল ফাউল বই পড়ে? উনি তখন চুপ করে যেতেন।
সেইভার উনি লেখা লেখি করে বিজ্ঞান বিষয়ক একটি প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলেন। উনাকে একটি মেডেল ও দেওয়া হয়েছে। সাথে অনেক গুলো বই। তারপরও কেউ খুশি হয় নি। এমনকি রাত্রি আপুও না। আমি ভেবেছিলাম এবার রাত্রি আপু একটু হলেও শুভ ভাইয়ার সাথে কথা বলার চেষ্টা করবে। করে নি। অথচ এই পুরষ্কারটা যদি অমিত ভাইয়া পেত, সবাই অমিত ভাইকে বাহ বাহ দিত। যদিও অমিত ভাই এসব নিয়ে তেমন একটা মাথায় ঘামান না।
এরপরে একদিন টিভির একটা বিজ্ঞান বিষয়ক প্রোগ্রামে শুভ ভাইয়াকে ডাকছিল। শুভ ভাইয়া সেখানে বিজ্ঞান নিয়ে অনেক জটিল জটিল কথা বলছিলেন। পরে তা টিভিতে দেখানোর পর সবাই শুভ ভাইয়াকে আস্তে আস্তে দাম দিতে লাগলেন।
আগে আমার সাথের ছেলে মেয়ে, যারা বলতেন শুভ ভাইয়ার মাথায় একটু সমস্যা আছে, তারাও শুভ ভাইয়াকে দূর থেকে দেখলেই সালাম দেওয়া শুরু করল।
এসব দেখে আমি এবার ভাবলাম রাত্রি আপু এবার শুভ ভাইয়ার সাথে কথা বলবে। এবারও বলে নি। আমি শুভ ভাইয়াকে বললাম আপনি রাত্রি আপুর সাথে নিজের থেকে কথা বলেন না কেন? শুভ ভাইয়া বলল রাত্রি যদি রাগ করে?
আমি চিন্তা করলাম কেন আবার রাত্রি আপু রাগ করতে যাবে?
পরে একদিন দেখলাম রাত্রি আপু কোথাও যাচ্ছে। আমি বললাম আপু শুনুন একটু। আপনাকে শুভ ভাইয়া ডাকে। উনাকে এ কথা বলার পর রাত্রি আপু বলল কেন? আমি বললাম আমি কি জানি।
পরে উনি যখন শুভ ভাইয়ার কাছে যাচ্ছিল আমি দিলাম এক দৌড়। পরে দুই দিন শুভ ভাইয়ার সাথে দেখা করি নি।
তৃতীয় দিন দেখি শুভ ভাইয়া আর রাত্রি আপু বসে বসে কথা বলছে। আমাকে ভয়ে ভয়ে যেতে দেখে দুইজনই মুচকি হাসল। আমি অভাক হলাম। আমার বুঝতে বাকি থাকল না যে গত পরশু থেকেই তারা কথা বলে আসছে। আমার কাছে পরে ভালোই লাগল।
ভালো লাগাটা আস্তে আস্তে কমে যেতে লাগল। কারন যেখানে আমি আর শুভ ভাইয়া বসে বসে কথা বলতাম সেখানে শুভ ভাইয়া আর রাত্রি আপু। এর পর এক সময় খারাপ লাগতে শুরু করল। কারন আগে আমি বেশির ভাগ সময়ই শুভ ভাইয়ার সাথে কাটাতাম। এখন কাটায় রাত্রি আপু। আমার নিজের উপরই বিরক্ত লাগল তখন।
এভাবেই চলছিল অনেক দিন। উনাদের ফাইনাল পরীক্ষার পর একদিন শুভ ভাইয়া বলল আমি চলে যাচ্ছি। আমি জিজ্ঞেস করলাম কোথায়? উনি বলল বিদেশ। কি একটা স্কলারশীপ পেয়েছে। পড়ালেখা করতে যাচ্ছে। শেষ হলে আবার চলে আসবে। শুনে আমার মন অনেক খারাপ হলো। কারন আমি কার কাছ থেকে বিজ্ঞান সম্পর্কে জানব? রাত্রি আপুকে ঐদিন না দেখে আপুর কথা জিজ্ঞেস করলাম। শুভ ভাইয়া বলল রাত্রি আপু রাগ করছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম কেনো। উনি বলল, আমি কেন বিদেশ যাচ্ছি এসব নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়েছিল। আমাকে নিষেধ করেছে বিদেশ যেতে। আমি যাবো কেনো তাই। শুভ ভাইয়া আবার বলল আমি তো কয়েকদিন পরই আবার চলে আসব, তারপর ও কেন রাগ করল বুঝতে পারছি না।
আমার তখনও বিশ্বাস হচ্ছিল না যে শুভ ভাইয়া চলে যাবে। যাওয়ার আগেরদিন আমাকে ঢেকে উনার সব গুলো বই আমাকে দিয়ে গিয়েছিল। বই গুলো অন্য সময় পেলে আমি খুসিতে আত্মহারা হতমা, কিন্তু ঐদিন উলটো আমার কান্না পাচ্ছিল। ভিষন কান্না। শুভ ভাইয়া যাওয়ার আগে রাত্রি আপুদের বাসায় গিয়েছিল। রাত্রি আপুর সাথে কথা বলতে চেয়েছিল। কিন্তু রাত্রি আপু কথা বলে নি।
যাওয়ার সময় আমার কান্না দেখে শুভ ভাইয়া আমাকে উনার ফেসবুক আইডি আর মেইল এড্রেস দিয়ে গিয়েছিল। বলছিল কান্নার কি আছে। আমরা তো সব সময়ই কথা বলতে পারব। প্রতিদিন চ্যাট করতে পারব। ভিডিও কল করে একজন আরেক জনকে দেখতে পারব। তারপর ও আমার কান্না পাচ্ছিল।
যাওয়ার আগে আমার হাতে ছোট্ট একটা কাগজ দিয়ে বলছিল যেন রাত্রি আপুকে দি।
ছোট্ট একটি বাক্য ছিল ঐ কাগজে।
“অপেক্ষা করবে না আমার জন্য? – শুভ”
শুভ ভাইয়া যাওয়ার অনেক দিন পর পর্যন্ত রাত্রি আপু বের হন নি বাসা থেকে। সবার সাথে কথা বলাও কমিয়ে দিয়েছিলেন। আমার সাথেও কথা বলেন নি অনেক দিন। পরে যদিও আমি আর রাত্রি আপু শুভ ভাইয়ার প্রিয় জাগায় বসে বসে শুভ ভাইয়ার কথা বলতাম। রাত্রি আপুর মোবাইল থেকে কথা বলতাম শুভ ভাইয়ার সাথে। আর আমরা দুইজনই অপেক্ষা করতাম শুভ ভাইয়ার জন্য।
পুনশ্চঃ শুভ ভাইয়া চলে যাওয়ার পর আস্তে আস্তে শুভ ভাইয়ার জায়গাটা আমি দখল করলাম। ইফতি আমার সাথে আগে কথা না বললেও এখন নিয়মিত কথা বলে। ফেসবুকে প্রায় সময়ই চ্যাট করতাম। আর বাবা বা মা আসলে উইকিপিডিয়া খুলে এমন ভাব ধরতাম আর তারা ভাবত আমি কি মনযোগ দিয়েই না পড়ালেখা করি। আর মাঝে মাঝে ভাবতাম আমিও যদি শুভ ভাইয়ার মত বিদেশ পড়ালেখা করতে যাই, তাহলে ইফতির কি হবে? ইফতিকে আমি এত কষ্ট দিতে পারব?