আমি গিয়েছি বাড়িতে, লক্ষীপুরে। বাইক নিয়ে। রাতে হাসিন ভাই জিজ্ঞেস করল শিমুল বাগান যাবো কিনা। আমি জিজ্ঞেস করলাম কখন। বলল পরের দিন রাতে। হিসেব করে দেখলাম সকালে ঢাকার দিকে রওনা দিলে দুপুরে পৌঁছানো যাবে। এরপর রেস্ট নিয়ে রাতে শিমুল বাগানের দিকে রওনা দিয়ে দেওয়া যাবে। বললাম যাবো।
আমরা রওনা দিয়েছি ২০ তারিখ রাতে। সবাই মিলে একত্রিত হয়েছি মিরপুরের কালশীতে। শেখান থেকে প্রায় বারোটার দিকে রওনা দেই। এই রাত বারোটার দিকেও উত্তরায় জ্যাম। আস্তে আস্তে যেতে লাগলাম আমরা। ১৪টা বাইক এক সাথে। সারিবদ্ধ হয়ে একের পর এক। গাড়ি থেকে যাত্রীরা বা অন্যান্য পথচারি আমাদের দেখল অবাক হয়ে।
গাজিপুরের দিকে একটা রেস্টুরেন্টে বসে আমরা নাস্তা করে নেই। এরপরের রাস্তা মোটামুটি ফাঁকা। রাতের বেলা আমরা যেতে লাগলাম। থামলাম ময়মনসিংহ এ। বসে সবাই মিলে চা খেয়ে নিলাম। নেত্রকোনা পোঁছাতে পৌঁছাতে সকাল হয়ে গেলো। আমাদের গন্তব্য হচ্ছে তাহিরপুর। তাহিরপুরেই রয়েছে শিমুল বাগান, বারেকটিলা, টেকেরঘাট। সবই মোটামুটি কাছাকাছি।
তাহিরপুর হচ্ছে সুনামগঞ্জ। সুনামগঞ্জ পৌঁছার ভালো রাস্তা রয়েছে। আমরা বেঁচে নিয়েছি অফরোড। নেত্রকোনার পর অফরোড রোড শুরু। এত ভয়াবহ রাস্তা। বাইক এবং রাইডার, দুইটারই অবস্থা শেষ হওয়ার যোগাড়। এছাড়া কিছু কিছু জায়গায় রাস্তাও নেই। মাঠের মাঝখান দিয়ে বাইক নিয়ে নেমে যেতাম। মাঝে মাঝে নদী বা খাল রয়েছে। দুইটা নদী পার হয়েছি ফেরি বা ছোট নৌকাতে করে। আর একটা খালের উপর বাঁশের ছাটাই ছিল। তার উপর দিয়ে বাইক চালিয়ে পার হয়েছি।
২১ তারিখ। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ভোরে দেখলাম অনেক ছাত্র ছাত্রী ফুল নিয়ে বের হলো। দেখলাম প্রভাত ফেরি। শহীদ মিনারে গিয়ে সবাই ফুল দিচ্ছে।
সুনামগঞ্জ পৌছে আমরা সকালের নাস্তা করে নেই। ভর্তা, ভাত আর ডাল। এরপর রওনা দেই তাহিরপুরের দিকে। প্রতিটা ফেরি পার হতে তো টাকা দিতে হয়, এটা স্বাভাবিক। মাঝে মাঝে কাঁচা রাস্তা দিয়ে পার হতেও দেখলাম টাকা দিতে হয়। ভাঙ্গা রাস্তার মধ্যে মাঝে মাঝে অনেক ভালো রাস্তাও পেলাম। সিমেন্টের ডালাই দেওয়া রাস্তা। দুই পাশেই ধান খেত। তখন বাইক চালাতে কি যে ভালো লেগেছে, তা বোঝানো যাবে না।
সুনামগঞ্জ আমরা একটা স্কুলের মাঠে দাঁড়াই। ঐখানে অনেক ছেলে মেয়ে এবং মানুষ এত বাইক দেখে দেখতে আসে। এক ভাই ছোট ছোট বাচ্চাদের বাইকে উঠিয়ে রাইড দেয়। বাকিরা বাইকের পেছনে দৌঁড়াতে থাকে। মনে হচ্ছিল যেন হ্যামিলিয়নের বাইকওয়ালা। আমাদের সবার চোখে ঘুম। মন চাচ্ছিল ঘুমিয়ে পড়ি। এছাড়া উঁচু নিচু রাস্তায় বাইক চালিয়ে শরীরও ব্যথা। রেস্ট নিলে তো আর তাহিরপুর পৌঁছানো যাবে না। তাই আবার রওনা দেই।
প্রায় একটার দিকে আমরা পৌঁছাই তাহিরপুর বাজার। সেখানে রুম ঠিক করে ব্যাগ রেখে রওনা দেই শিমুল বাগানের দিকে। তাহিরপুর বাজার থেকে কাছেই। শিমুল বাগানে গিয়ে দেখি শিমুল ফুল থেকেও মানুষ বেশি। শিমুল বাগানটা বিশাল। অনেক সুন্দর সারিবদ্ধ ভাবে গাছ গুলো। সব গুলো গাছেই শিমুল ফুল। সুন্দর লাগছিল। এই বাগানটি ১০০ বিঘা জমির উপর তৈরি।শিমুল গাছের মাঝে মাঝে রয়েছে লেবু গাছও। যদিও শিমুল ফুলের সৌন্দর্যের কারণে লেবু গাছ তেমন একটা চোখে পড়বে না। কিছুক্ষণ থেকে আমরা রওনা দিলাম বারেকটিলার দিকে।
শিমুল বাগানে আমি এর আগেও এসেছি। তখন ফুল ছিল না। আর তখন এসেছি নৌকায় করে। যেখানে নৌকায় এসেছি, এখন সেখানে বাইক দিয়ে যেতে পারছি। বারেকটিলায় গিয়ে অবাক হওয়ার যোগার। যাদুকাটা নদীতে কোন পানি নেই। নিচে পাথর তোলা হচ্ছে। অনেক গুলো ইঞ্জিন চলছিল। আর তার ধৌঁয়ায় আকাশ ঘোলা হয়ে আছে। যেখানে বর্ষাকালে দেখলাম কত সুন্দর স্বচ্চ পানি, সেখানে কেমন সব শুকিয়ে আছে। কেমন জানি লাগল। টাঙ্গুয়া হাওর, যাদুকাটা নদী বা নীলাদ্রী লেখ বর্ষায় কেমন, তা দেখা যাবে এই পোস্ট থেকে।
বারেকটিলা থেকে গেলাম টেকের ঘাটে। বাইকে করেই। এর আগে এসব জায়গায় নৌকা করে ঘুরেছি। একবার এত বেশি পানি ছিল যে সুনামগঞ্জ এসে ফিরে যেতে হয়েছে। পুরা এলাকা পানির নিচে ছিল। এত বেশি পানি ছিল যে সাগরের মত ঢেউ হচ্ছিল। আর তাই নৌকা গুলোও চালানো বন্ধ করে দিয়েছিল। ঢাকা থেকে গিয়ে না ঘুরেই ফিরে যেতে হয়েছিল। এরপরে যদিও আবার সুনামগঞ্জ গিয়ে এই জায়গা গুলো ঘুরতে যাই। টাঙ্গুয়া হাওর, বারেকটিলা, টেকেরঘাট সবই ঘুরি। তখন ছিল এক রুপ। এখন অন্য রুপ। এখন কিছু মাঠে ধান খেত। আর বাকি যেগুলো, সেগুলোতে বালি উড়ে। এই বালির মধ্য দিয়েই বাইক চালাচ্ছিলাম আমরা।
টেকেরঘাট গিয়ে ঐখানের লেকে নেমে গোসল করি। টেকেরঘাটের এই লেককে বলে নীলাদ্রী লেক বা লাইমস্টোন লেকও বলে থাকেন। নীলাদ্রী নাম হওয়ার কারণ হচ্ছে এর পানির রং নীল। আর লাইমস্টোন লেক বলার কারণ হচ্ছে এটা তৈরি হয়েছিল মূলত চুনাপাথর উত্তোলনের কারণে। তাই হয়তো। লেকের পানি ছিল ঠান্ডা। গোসল করতে ভালোই লাগছিল। গোসল করে গেলাম বড়ছড়া বাজারে। দুপুরের খাবার খেতে হবে। কোন হোটেলেই পর্যাপ্ত পরিমান খাবার নেই। একটাতে গিয়ে বললাম যা আছে, তাই দেন। খাওয়া শুরু করি। ভাত, মাছ, ভর্তা, ডাল দিয়ে খেলাম। ভালোই লাগল। খাওয়ার পর ঘুম পাচ্ছিল। অন্য সবার খাবার খেতে খেতে একটু ঘুমিয়েও নিলাম। টেবিলের উপর মাথা দিয়ে। এই কাজটা আমি ভালোই পারি সম্ভবত। ইউনিভার্সিটিতে অনেক ঘুমাইছি এভাবে। রাতে জেগে থাকতাম। প্রায় সময় ক্লাসে গিয়ে ঘুমাতাম। স্যারেরা ক্ষমা করে দিলেই হয়।
খাওয়া দাওয়া করে আবার রওনা দেই তাহিরপুর বাজারের দিকে। ফেরার সময় আবার বারেকটিলায় ঢুঁ মেরে যাই।পাহাড়ি রাস্তা। বাইক চালাতে দারুণ লাগছিল। এরপর শিমুল বাগানে। তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছিল। রঙ্গিন আলোতে সিমুল বাগান আরো বেশি সুন্দর লাগছিল। সন্ধ্যার পর রওনা দেই হোটেলের দিকে। আর জেগে থাকতে কষ্ট হচ্ছিল। ঘুমিয়ে পড়লাম। ৯টার দিকে উঠলাম খাবার খাওয়ার জন্য। পাশে একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে খেতে বসি। মাছ, মাংশ, ভর্তা। সবই ভালো লাগছিল। দেশি মুরগি এত বেশি ভালো লাগছিল যে আমরা দুইবার করে নিয়েছিলাম।
খাওয়া দাওয়া করে তাহিরপুর বাজারে ঘুরতে লাগলাম কিছুক্ষণ। ঐখানে একটা রেস্টুরেন্টে দেখলাম গরম মিষ্টি পাওয়া যাচ্ছিল। গরম গরম মিষ্টি খেয়ে নিলাম। এরপর রুমে এসে ঘুম। সকালে জেগেছি প্রায় দশটার দিকে। উঠে নাস্তা করতে চলে যাই। নাস্তা করে আবার রওনা দেই শিমুল বাগানের দিকে। বাইক নিয়েই। শিমুল বাগান থেকে আবার বারিকটিলায়। এরপর ফিরে আসি তাহিরপুর বাজারে। আমি আর জাহাঙ্গীর ভাই প্ল্যান করলাম আমরা সিলেটের দিকে যাবো। বাকিরা ঢাকায় ফিরবে। তাহিরপুর থেকে রওনা দিলাম সুনামগঞ্জের দিকে। এরপর সিলেট। তাহির পুর থেকে সুনামগঞ্জ যাওয়ার রাস্তাটা একটু খারাপ হলেও সুনামগঞ্জের রাস্তা ভালো ছিল। দুই পাশেই ছিল ধান খেত। বাইক চালাতে কি যে ভালো লেগেছিল। হাওর এলাকার তিনরূপ দেখার সোভাগ্য হলো। যখন সব পানির নিচে, রাস্তা ঘাট সব সহ – ভয়ঙ্কর রূপ। আর যখন মোটামুটি পানির নিচে। এবং শুকনো মৌসুম।
আমাদের টিমটি দারুণ ছিল। সবাই অনেক হেল্পফুল ছিল। এছাড়া যারা সামনে থাকত, তারা সর্বদা বিভিন্ন সিগনাল দিত। যেমন রাস্তা খারাপ হলে, উঁচু নিচু রাস্তা হলে অথবা কোন গর্ত ইত্যাদি দেখলে। সতর্ক ভাবে চালালে বাইক দিয়ে ট্যুর দেওয়া আসলে অনেক মজার।