আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেলের মধ্যে সুরিদ সব চেয়ে সাহসী। শুধু দুটি বিষয় ছাড়া। একটা হচ্ছে রক্ত। রক্তকে সে ভয় পায়। আরেকটির কথা পরে বলব।
২০১০ এর দিকে আমরা একটা ছোট সামাজিক কাজ শুরু করছি। তা হচ্ছে এলাকায় রক্ত দিতে পারে এমন এবং আগ্রহীদের একটা লিস্ট তৈরি করেছি। তাদের নাম, ঠিকানা এবং মোবাইল নাম্বার দিয়ে। ঐ লিস্টে সবার নাম থাকলেও সুরিদের নাম নেই। যেখানে আমাদের টীমে সেও কাজ করে। কারন সে রক্ত দিতে ভয় পায়। তবে অন্য যে কোন কাজ সে কোন প্রশ্ন ছাড়াই করে দেয়।
কারো যদি রক্তের দরকার হয় তাহলে তা জানাতে হয় মেহেদীর কাছে। মেহেদী পরে কে রক্ত দিতে পারবে, কে সব চেয়ে কাছে আছে এসব চিন্তা করে ঠিক করে।
কাজ আরো সহজ করার জন্য সবাই বলল আমাদের লিস্টটা ডিজিটালাইজ করে দিতে। সে দায়িত্ব পড়ল আমার উপর। আমাদের লিস্ট নিয়ে একটা ছোট্ট সফটওয়ার তৈরি করলাম। কাস্টম সার্চ এর মাধ্যমে এখন সহজেই রক্তদান কারীদের খুজে বের করা যায়।
আমাদের পাশের বাড়ির নিজাম আংকেল কয়েক দিন থেকে অসুস্থ। উনার হার্টে বিশাল ব্লক ধরা পড়ছে। অপারেশন করতে হবে। অল্প সল্প সমস্যা হলে এখন মেশিনের মাধ্যমে কাটা কুটি ছাড়াই ব্লক রিমুভ করা যায়। কিন্তু উনারটা কন্ট্রোলের বাহিরে চলে গেছে।। দরকার রক্তের।
মেহেদীর কাছে ফোন আসছে। উনার ব্লাড গ্রুপ AB-। রেয়ার ব্লাড গ্রুপ। আমাদের এলকায় মাত্র ৩ জন রয়েছে যাদের ব্লাড গ্রুপ AB-. এদের একজন কয়েকদিন আগে রক্ত দিয়েছে একবার। এখন আর রক্ত দিতে পারবে না। বাকি দুইজন এলাকায় নেই।
মেহেদী ফোন দিল আমাকে। আমি চিন্তা করলাম আমাদের সুরিদকে নিয়ে। তার রক্তের গ্রুপ ও AB-
আমরা দুই জনই জানি সুরিদ রাজি হবে না। তবে একটু চেষ্টা করলে কাজ হবে। কারণ আমাদের এলাকার ছেলেদের হার্টথ্রুব মেয়ে হচ্ছে লাইজু। আর তার বাবা হচ্ছে নিজামী আংকেল। লাইজুর কথা শুনলে সুরিদ এমনিতে গলে যাবে। পরে রক্ত না শুধু হার্ট খুলে দিতে বললেও মনে হয় দিয়ে দিবে।
আমি নিজেই ফোন দিলাম সুরিদকে। বললাম দ্রুত আসতে, জরুরী কাজ আছে। রিক্সায় করে চলে গেলাম হাসপাতালে।
সুরিদ জিজ্ঞেস করল এখানে কেন? আমি বললাম আয়। রক্ত নেওয়ার রুমে নিয়ে ওকে বললাম হাতা গুছিয়ে নে, তোকে রক্ত দিতে হবে।
শুরিদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। জিজ্ঞেস করল আমি রক্ত দিব?
আমি বললাম হ্যা। কাকে রক্ত দিতে যাচ্ছিস তা শুনলে তোর হার্ট ও খুলে দিতে পারিস।
সুরিদ জিজ্ঞেস করল কাকে?
আমি বললাম লাইজুর আব্বুকে।
এদিকে মেহেদী গিয়ে লাইজুর আম্মুকে বলল রক্ত জোগাড় হয়েছে। ডাক্তারকে যেন বলে অপারেশন থিয়েটার রেডি করতে।
কে রক্ত দিচ্ছে তা দেখার জন্য লাইজু আসছে।
রক্ত দেওয়ার পর মানুষ এমনিতেই একটু দুর্বল থাকে। আর প্রথম বার হলে তো একটু বেশিই দুর্বল হয়। সুরিদ বিছানায় তখনো শুয়ে ছিল। লাইজু আসার সাথে সাথেই বসে পড়ল।
লাইজু সুরিদকে ধন্যবাদ দিল। এর পর সুরিদ যে ভাবে লাইজুর সাথে কথা বলল আমরা তা কেউই চিন্তা করতে পারি নি।
সুরিদ লাইজুকে জিজ্ঞেস করল, তোমার আব্বুর রক্তের গ্রুপের সাথে তোমার রক্তের গ্রুপের মিল থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। তোমার রক্তের গ্রুপও কি AB-?
লাইজু বলল, হ্যা।
আমারও AB- তা মনে হয় আর বলতে হবে না। তুমি তো সাইন্সে পড়ো তাই না?
লাইজু বলল হ্যা।
Rh ফ্যাক্টর সম্পর্কে জানো?
লাইজু বলল হ্যা, একটু একটু।
তাহলে মনে হয় এটাও জানো যে, Rh- কোন মেয়ের সাথে Rh+ কোন ছেলের বিয়ে হলে তাদের সন্তানের রক্ত রসে অ্যান্টি Rh ফ্যাক্টর (আন্টিবডি) উৎপন্ন হবে এবং ঐ সন্তানদের দেহে প্রচন্ড রক্ত স্বল্পতা দেখা দেবে। এরিথ্রব্লাস্টোসিস ফিটালিস রোগ হবে।
তাই বলছিলাম কি তোমার ভবিশ্যতের কথা চিন্তা করতে। তোমাকে আর Rh- রক্ত যুক্ত কাউকে খুজে নিতে হবে না। বিয়ের আগে ছেলের রক্ত পরীক্ষা করাও কেমন বেমানান দেখায় তাই না? তাই বলছিলাম কি…
সুরিদ তার কথা শেষ করতে পারে নি। তার আগেই লাইজু লজ্জা পেয়ে রুম থেকে বের হয়ে গিয়েছে।
আমরা অবাক হয়েছি এ জন্য যে সুরিদ যেখানে কোন দিন লাইজুর সাথে কথাই বলে নি। যে কোন মেয়ের সাথে গেলেই কথা বলতে আটকে যায় এবং একটু ভয় ও পায়, সে সুরিদ কিভাবে এত কথা বলল আজ?
আমাদের অভাক আরো হতে হবে তাও আমরা ঐ দিন ভাবতে পারি নি। মেয়েদের ভয় পাওয়া ছেলেটিকে এর পর প্রতিদিনই একবার না একবার লাইজুর সাথে আড্ডা দিতে দেখা যেতো।। আর তাদের ফ্যামিলি?? হ্যা, লাইজুদের ফ্যামিলিতে সুরিদ তো একটা নায়ক।