জুলাই এর ১০ তারিখ, বুধবার রাতে জ্বর আসে আমার। ডেঙ্গু কিনা, তখনও জানি না। সাথে মাসল এবং জয়েন্ট পেইন। ১০ এ জুলাই। আগের দিন আমি ব্যায়াম করি। তাই ভাবলাম হয়তো মাসল পেইন থেকেই এই জ্বর। রাত বাড়ার সাথে সাথে জ্বর বাড়তে থাকে। ঘুমাতে কষ্ট হচ্ছিল। ভাবলাম ঘুম থেকে উঠলে হয়তো জ্বর সেরে যাবে। তাই প্যারাসিটামলও খাইনি।
পরের দিন ঘুম থেকে উঠার পরও জ্বর। একটু কম। প্যারাসিটামল খেয়ে নিলাম। দিন কোন ভাবে কেটে গেলো। রাতের দিকে জ্বর গেলো বেড়ে। এত বেশি পেইন। সয্য করতে পারছিলাম না। অ্যাপলোতে কল দিলাম পরের দিন ডক্টরের এপয়েনমেন্ট নেওয়ার জন্য। জানালো শুক্রবার ডাক্তার বসেন না।
রাতে আরো বাড়ছিল জ্বর, সাথে পেইন। সয্য করতে পারছিলাম না। নাঈমাকে বললাম চল, জরুরী বিভাগ থেকে ঘুরে আসি। রাতের দুইটার দিকে চলে গেলাম অ্যাপলো হসপিটাল। বাসার কাছেই ছিল। হসপিটাল যেতে যেতে একটু ভালো লাগল। জ্বরও কমে আসল। জ্বর মাপল, দেখল কমই আছে। উনারা বলল প্যারাসিটামলই খেতে। আমাকে কোন চার্জও করল না। বাসায় ফিরলাম হেঁটে হেঁটে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। ভালোই লাগছিল। মনে হচ্ছিল আমি বুঝি সুস্থ হয়ে উঠছি।
কিন্তু বাসায় আসার পর আবার জ্বর আসতে লাগল। পরের দিনও জ্বর। শুক্রবার ছিল। ডাক্তার বসে না। ভাবলাম পরের দিন দেখাই। শনিবারে এপয়েনমেন্ট নিলাম। রাতটা কি কষ্টেই না কেটেছে। ওষুধ খাওয়ার মধ্যে শুধু প্যারাসিটামল খাচ্ছি। তা একটু পেইন কমায়। কিছুক্ষণ জ্বর কমে যায়। আবার বাড়ে। যতক্ষণ কম থাকে জ্বর ,ততক্ষণ মনে হয় আমি সুস্থ। কিন্তু জ্বর আসার পর বুঝা যায় কত কষ্ট!
শনিবার সকালে চলে গেলাম ডাক্তার দেখাতে। ডাক্তার দেখে টেস্ট দিল। ডেঙ্গু এবং অন্যান্য টেস্ট। ওষুধের মধ্যে দিল শুধু প্যারাসিটামল এবং খাবার অরুচি যেন না হয়, এমন ঔষধ।
শনিবার রাতেও জ্বর এসেছে। যতক্ষণ জ্বর থাকত শরীরে, ততক্ষণ পেইনের মধ্যে থাকতে হত। আমি শনিবার রাতেই বুঝে গিয়েছি আমার ডেঙ্গু। এত বেশি কষ্ট হচ্ছিল। সাথে দুইবার বমি হয়েছিল। পেটে খাবার কিচ্ছু ছিল না বলতে গেলে। এরপর পানি খাওয়ার পরই বমি। কষ্টকর অভিজ্ঞতা।
রবিবার সকালে চলে গেলাম রিপোর্ট নিতে। রিপোর্ট হাতে পারার পর নিজেই দেখলাম ডেঙ্গু পজেটিভ! একা একাই যেতে পেরেছি। বুঝতেই পারছেন কতটুকু সুস্থতা অনুভব করছি আমি।
ডাক্তার দেখে বলল প্যারাসিটামলই খেতে। প্রতিদিন CBC টেস্ট করতে বলল। আর প্রচুর ফ্লুইড খেতে বলল। আর বলল প্ল্যাটলেট কাউণ্ট ১০০ এর নিচে নামলে হসপিটালাইজড হতে।
সোমবারে রিপোর্ট পেলাম রবিবারের। প্ল্যাটল্যাট কাউণ্ট শনিবারে ছিল ১৬০। রবিরারে ছিল ১৫০। এদিকে জ্বর ও আর নেই। বলা যায় আমি সুস্তটার দিকে। শারীরিক ভাবে শুধু এলার্জি হয়েছে সারা শরীরে। আর একটু দুর্বল লাগছিল।
মঙ্গল বারে গেলাম সোমবারের রিপোর্ট আনতে। রিপোর্ট দেখে আমি নিজেই অবাক। মাত্র ৪০। ১৫০ থেকে এক ধাপে মাত্র ৪০। মানে ১ লক্ষ ১০ হাজার প্ল্যাটলেট এক দিনেই নাই হয়ে গিয়েছে।
CBC এর আরেকটা টেস্ট দিয়েই ডাক্তারের কাছে গেলাম। উনি বলল হসপিটালাইজড হতে। আর পারলে আমার গ্রুপের রক্তদাতা ম্যানেজ করে রাখতে। তখন বিকেল হয়ে গিয়েছে। বাসায় এসে রেডি হয়ে হসপিটাল চলে গেলাম।
রাতে আমাকে ফ্লুইড দিয়ে রাখল। আমি কোন অসুস্থতা অনুভব করছি না। দুর্বল লাগলে যেমন লাগে, ঠিক এমন। এর বেশি কিছু না। পায়ের দিকে এক জায়গায় রক্ত জমে গিয়েছিল। অল্প একটু জায়গায়। পরে যদিও তা আস্তে আস্তে ভালো হয়ে গিয়েছে।
পরের দিন বুধবার সকালে আবার টেস্ট করল। প্ল্যাটলেট কাউণ্ট ইম্প্রুভিং। ৫৫। ডাক্তার আসল। দেখল। বিকেলের দিকে আবার দেখতে এসে বলল আর ফ্লুইড না দিলেও হবে।
রাতে আবার CBC. টেস্ট করল। আরেকটু ইম্প্রুভিং। ৮০। এর মধ্যে আল্টাসনোগ্রাম করল। বলল লিভারে পানি জমেছে কিছু। এবং ডেঙ্গু হলে এমন হয়।
বৃহস্পতিবার সকালে আবার টেস্ট করল। আরেকটূ ইম্প্রুভিং। ১২০। এরপর ও স্বাভাবিক প্ল্যাটলেট কাউণ্ট থেকে কম। ডাক্তার রিলিজ দিয়ে দিলেন। বললেন তিনদিন পর দেখা করতে।
রবিবারে টেস্ট করতে দিয়ে এসেছি, লিভার ফাংশন টেস্ট এবং CBC। সোমবার রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছি। প্ল্যাটলেট কাউন্ট স্বাভাবিক হয়েছে। লিভার ফাংশন টেস্ট ভালো আসেনি। ডাক্তার বললেন আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।
ডাক্তার দেখে ভিটামিন ঔষধ দিয়েছে। ডেঙ্গু হলে এলার্জি হয়। বলল এলার্জি হলে ঔষধ খেতে।
এখনো পুরাপুরি সুস্থ না। তারপরও মনে হচ্ছে মৃত্যুর খুব কাছ দিয়ে ঘুরে এসেছি। ডেঙ্গু যাদের হয়,জ্বর কমার পরই মূল সমস্যা শুরু হয়। তখন মনে হয় সব স্বাভাবিক। কিন্তু শরীরের ভেতরে সব কিছু কেমন নষ্ট করে দেয়। আর বেশির ভাগ রুগী তখনই মারা যায়। হুট করেই। দোয়া করবেন যেন শারীরিক ভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠতে পারি।
জ্বর হওয়ার পর এবং প্রচণ্ড ব্যথা হওয়া সত্ত্বেও আমি কোন পেইন কিলার খাই নি। ভুল করে যদি খেয়ে ফেলতাম,তাহলে ভয়াবহ কিছু হয়ে যেতো। পেইন কিলার খেলে ব্লিডিং হতো। যেহেতু ডেঙ্গু হলে প্ল্যাটলেট বা অণুচক্রিকা কমে যায়, তাই বিল্ডিং বন্ধ হত না। আর তখন ভয়াবহ কিছু হতে পারত। তাই কারো জ্বর হলে সঠিক ডায়াগনোসিস ছাড়া কোন ঔষধ না খাওয়ার অনুরোধ থাকল। ডেঙ্গুর কোন ঔষধ নেই।
শুধু সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। মশা থেকে খুব সতর্ক থেকেও ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে পারলাম না। কিভাবে কি হয়ে গেলো। এরপর ও সাবধানে থাকবেন সবাই। মশা থেকে দূরে থাকবেন। দোয়া করি যেন আপনাদের কারো এমন ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে না যেতে হয়।
ডেঙ্গু হওয়ার পর শরীর অনেক বেশি দুর্বল হয়ে যায়। এছাড়া ব্যথাও থেকে যায় অনেক দিন। ব্যথা অনেক দিন থাকার কারণে আমি গত সপ্তাহে আবারও ডাক্তারের কাছে যাই। বলল নিয়মিত হাঁটা চলা করতে। এছাড়া বাড়তি ভিটামিন ঔষধ দেয়।
জানি না অন্যরা কেমন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যায় বা যাচ্ছেন। আল্লাহ সবাইকে সুস্থ রাখুক। ভালো রাখুক।
অনলাইনে অনেক আজেবাজে টিপস শেয়ার করতে দেখি অনেকেই। এসব টিপস ফলো করার কোন মানে হয় না। জ্বর হলেই ডাক্তার দেখান। এরপর ডাক্তারের পরামর্ষ অনুযায়ী চলবেন। এই কয়েক দিনে ডেঙ্গুতে এত বেশি মানুষ মারা যাওয়ার খবর শুনেছি যে, কেমন অস্থির লাগে। কারণ এটা যে কাউকে আক্রমণ করতে পারে। মশা কোন পাশ দিয়ে রুমে ঢুকবে, কখন কাকে কামড়াবে, একটুও বুঝতে পারবেন না। এমন না যে শুধু বাসায়ই কামড়াবে। রাস্তায় বের হলেও কামড়াতে পারে। দেখলাম এক হাজারেরও বেশি পুলিশ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে। এদের তো সম্ভবত বাহির থেকেই কামড়িয়েছে। এরপর ও যতটুকু পারবেন, মশা থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করবেন।
Alhamdulillah !!
অভিজ্ঞতা শেয়ারের জন্য অনেক ধন্যবাদ। গ্রামেও ডেঙ্গু আসছে। আল্লাহর রহমতে যেন বেচে যাই।
অভিজ্ঞতা শেয়ারের জন্য অনেক ধন্যবাদ। সুস্থ থাকুন এই কামনাই করি।
এবারের ডেঙ্গু এক আতংকের নাম । ডেঙ্গু হইছে শুনলেই ভয় লাগে । আল্লাহ সবাইকে হেফাজত করুক ।
ডেঙ্গুর অভিজ্ঞতা না থাকলে আসলে বুঝা যায় না এর ভয়াবহতা। একেবারে দুর্বল করে রেখে যায় এই রোগ আর ডেঙ্গু থাকাকালীন ব্যাথা, খাবারের রুচিহীনতা, চুলকানি আর ঘুমাতে না পারা তো আছেই।