নিশি বৃষ্টিতে ভিজতে লাগলো। বাসা থেকে তার আব্বু যত ডাকে শুনছে না। বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর আসলে আবার সমস্যা হবে। তাই নিষেধ করছে। বাসায় শাহেদ ও রয়েছে। শাহেদ নিশির আব্বু মি. ফরিদ এর অফিসে চাকরি করে। কাজের প্রয়োজনে মাঝে মাঝে তাদের বাসায় আসতে হতো। বসে বসে ফরিদ সাহেবের সাথে কথা বলত। অফিসের দরকারি কথা দিয়ে শুরু হলেও পরে আর দরকারি কথাতে সীমাবদ্ধ থাকতো না। রাজনীতি, অর্থনীতি, খেলাধুলা এমনকি মহাকাশ নিয়েও কথা বলত তারা।
কোন কোন দিন ফরিদ সাহেব বাসায় থাকত না, তখন শাহেদ একা একা বসে থাকত। এভাবে বসে থাকতে দেখে নিশি শাহেদকে সময় দিত। এক জন আরেক জনের সাথে কথা বলত। একজন হোস্ট হিসবে একজন গেস্ট এর সাথে যে ধরনের কথা, তেমনি। ফরিদ সাহেব আসলে কথা বার্তা সেরে শাহেদ চলে যেতো।
একদিন নিশি জিজ্ঞেস করল শাহেদের বিকেলে কোন কাজ আছে কিনা। শাহেদ বলল, তেমন কিছু তো নেই। তাহলে বিকেলে এক সাথে বসে কফি খাওয়া যাক। রেস্টুরেন্টের নাম বলল। শাহেদ রাজি হলো।
শাহেদের ব্যক্তিত্ব হয়তো নিশির ভালো লাগা শুরু করল। শাহেদকে এক দিন লাঞ্চ, একদিন ডিনার, এক দিন চা এর দাওয়াত দিতে লাগলো। হাতে কাজ না থাকলে শাহেদ ও আসতো। তার মাথায় বসের মেয়ে ছাড়া অন্য কোন চিন্তা ঢুকে নি। এভাবেই চলল কিছু দিন। নিশিও নিজ থেকে কিছু বলে নি শাহেদকে।
কিছুদিন পর নিশি অসুস্থ হয়ে পড়লো। পরীক্ষা নিরীক্ষা করার পর জানতে পারল নিশির ব্লাড ক্যান্সার। তাদের পুরো ফ্যামিলিতে সবার মন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। ফরিদ সাহেব মেয়ের চিকিৎসা করার সব চেষ্টা করেছেন। ডাক্তার নিশির বেঁচে থাকার সম্ভাব্য সময় বলে দিল। নিশি মারা যাবার আগেই তাদের ফ্যামিলিতে শোকের ছায়া।
মেয়ে যেন যে কয়েক দিন বেচে থাকে, সুন্দর ভাবে হাসি খুশি ভাবে বেচে থাকতে পারে, তার সব চেষ্টাই তিনি করছেন। মেয়ে যা চায়, তা পূরণ আগে থেকেই করতেন। আর এখন তো পারলে নিজেকেও বিলিয়ে দিতে পারবেন। তাই মেয়েকে বৃষ্টিতে ভিজতে ভালো করে নিষেধ ও করতে পারেন না। ভাবেন, যদি বৃষ্টিতে ভিজতে তার ভালো লাগে, তাই করুক। আবার জ্বর আসার কথা মাথা থেকে দূর করতে পারেন না।
ফরিদ সাহেবের অস্থিরতা দেখে শাহেদ উঠে নিশিকে ডাকতে গেলো। তাদের বারান্ধায়। বারান্ধাটার অর্ধেকে ছাদ রয়েছে, অর্ধেক খোলা। ঐ অর্ধেকেই বৃষ্টির পানি পড়ে। বারান্ধায় যেতেই নিশি শাহেদকে বৃষ্টির পানি ছিটাতে লাগল। শাহেদ পিছিয়ে যেতে গেলে শাহেদকে উল্টো টেনে বৃষ্টির কাছে নিয়ে গেলো। শাহেদকেও ভিজিয়ে দিল।
ফরিদ সাহেব দেখেও না দেখার ভান করল। মেয়ের যা ভালো লাগে, করুক। যে কয়েক দিন বেঁচে থাকে, শান্তি মত বেঁচে থাক। ফরিদ সাহেব লক্ষ করল শাহেদ যতক্ষণ থাকে, মেয়েটি ততক্ষণ অনেক হাসি খুশি থাকে। মেয়েটি শাহেদকে পছন্দ করে না তো?
একদিন নিশিকে ঢেকে জিজ্ঞেস করল, শাহেদকে পছন্দ করে কিনা। নিশির খেয়ালি উত্তর। কাউকে ভালোবেসেও লাভ নেই। সবাই মারা যাবে, কেউই থাকবে না। কিন্তু সবার মৃত্যুটা অজানা। ঠিক নেই। নিশিরটা এখন একটা ফ্রেমে বন্ধী। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই আসবে। আহ!
নিশি ভাবে, কেমন হতো যদি এমন কিছু না হতো? ক্যান্সার নামক কোন রোগ পৃথিবীতে না থাকতো। এই ক্যান্সাররের কারণেই সে নিজের ভালোবাসার কথা বলতে পারছে না। তার বাবা মা, আত্মীয় স্বজন সবাই চিন্তা করে। স্বল্প সময়ে নিজের জীবনের সাথে আর কাউকে জড়াতে চাচ্ছে না। নাকি পারছে না? দ্বিতীয়টিই হবে। সে তো সব সময়ই চাইতো, চায়। চায় সময়কে স্থির করে দিতে। ডাক্তারের কথা মত ঐ সময়টা যেন কখনো না পুরায়। সে জানে, এটা রূপকথা না, বাস্তবতা। তাই সব মেনে নেয়। ক্যান্সাররের ব্যাথার সাথে আরেকটি ব্যাথা। ভালোবাসা প্রকাশ না করতে পারার ব্যথা।
ফরিদ সাহেব অনেক কিছু ভাবলেন। নিজের সাথে নিজের যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। একটা বিষয় নিয়ে। এক সপ্তাহ ঠিক মত ঘুমাতে পারেন নি। অবশেষে চিন্তা করলেন শাহেদ একবার বলে দেখা যাক।
শাহেদ আসার পর এটা সেটা বলেন, কিন্তু কথাটা বলতে পারেন না। শাহেদ বুঝতে পারল। বলল, আমাকে কি কিছু বলবেন?
ফরিদ সাহেব বললেন কিভাবে বলি। আসলে, তুমি আমাকে স্বার্থপর ভাববা। আরো খারাপ কিছু ভাবতে পারো। আমি যা করতে চাই, সব নিশির জন্য।
শাহেদ বল, আমাকে খুলে বলুন প্লিজ।
আসলে সে তোমাকে অনেক পছন্দ করে। তুমি যতক্ষণ আমাদের বাসায় থাকো বা তার সাথে থাকো, মেয়েটি অনেক আনন্দে থাকে। তুমি চলে যাওয়ার পর মনে হয় আবার তার মৃত্যু চিন্তা ফিরে আসে। আমি বলছিলাম কি সে যত দিন বেচে থাকে, তত দিন তুমি তার পাশে থাকো। আমি চাচ্ছি তুমি তাকে বিয়ে করো। তোমার ফ্যামিলিতে জানানোর দরকার নেই। তুমি অফিস থেকে ছুটি নিয়ে নিশিকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে চলে যাও… ফরিদ সাহেব এক নাগাড়ে কথা গুলো বলল। বলে নিজেই অনুতপ্ত হলো। কি সব বলছেন তিনি?
শাহেদ চিন্তায় পড়ল। কি বলবে সে? কি করা উচিত? একটি মেয়ে তাকে ভালোবাসে, যে চাচ্ছে তার বাকী সময়টুকু শাহেদের সাথে কাটাতে, তার কথা ভাববে নাকি স্বার্থপরের মত নিজের ভবিষ্যৎ এর কথা ভাববে?
শাহেদ ভাবল, সবাই তো মারা যাবে, কেউ আগে, কেউ পরে। একটি মানুষের মৃত্যুর সময় পাশে থাকা কয় জন্মের ভাগ্যে আছে? হয়তো বেশি মানুষের নেই। সে ফরিদ সাহেব কে বলল, আমি ফ্যামিলিকে জানিয়েই বিয়ে করব। তবে তাদের জানানোর দরকার নেই যে নিশির ক্যান্সার। বিয়ের পর জানা জানি হওয়ার সময়ও হয়তো নিশি পাবে না। বলার সময় তার নিজের চোখ কেন জানি ভিজে উঠলো। কেন এমন হলো? অদ্ভুত!
বিয়ের পর তারা ঘুরতে বের হলো। ডাক্তারের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখে। কোন সমস্যা হলে জানায়। কি করতে হবে তা করে। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় তারা ঘুরে বেড়ায়। এক মাসের ও বেশি সময় তারা এমন বাহিরে বাহিরে।
এক দিন সকালে শাহেদের ঘুম ভাঙ্গল নিশির কাশির আওয়াজ শুনে। সাথে জ্বর। ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো। ডাক্তারপরীক্ষা নিরীক্ষা করে জা জানালো, তা শুনে শাহেদের মাথায় হাত। এখন কি হবে?! নিশি নাকি প্রেগন্যান্ট!
আগে মারা যেত একটি প্রাণী, এখন দুটি। আর তা শাহেদের কোন এক ভুলের জন্যই।
শাহেদ অনেক হতাশায় ভুগতে শুরু করল। ঠিক মত খাওয়া দাওয়া খেতে পারে না। নিশির অবস্থা আস্তে আস্তে খারাপ হতে লাগল। সময় ঘনিয়ে আসছে। ঢাক্তারের রিপোর্ট অনুযায়ী আর ৭ থেকে ১০ দিনের মত নিশি বেঁচে থাকবে। তাই যতটুকু সম্ভব, নিশির সামনে নিজেকে ভালো রাখার চেষ্টা করে। নিশি যেন ভালো থাকে, তার সবটুকুই করার চেষ্টা করে। সে ভাবে কেমন হতো যদি এমন কিছু না হতো, কেমন হতো যদি এসব কিছুই বাস্তব না হতো। এক ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখল সব আগের মত। এসব কিছুই তার জীবনে ঘটে নি। কি দরকার ছিল মেয়েটি তার জীবনে আসার? আবার এভাবে চলে যাওয়ার ও বা কি দরকার?
সময় যত ঘনিয়ে আসে, শাহেদের চোখ থেকে ঘুম তত দূরে চলে যায়। নিশিও সারাদিন কি সব ভাবে। আগের মত কথা বলে না। খাওয়া দাওয়া ও তেমন খায় না। ব্যথা কমার জন্য মাঝে মাঝে শুধু কিছু ওষুধ নেয়। এরপর ওষুধ নেওয়াতেও অনিয়মিত হয়ে পড়ল। ফলফল হিসবে প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়ল। হাসাপাতাল ভর্তি হতে হলো।
ডাক্তাররা আস্তে আস্তে সব প্রিফারেশন নিচ্ছে। ঐ সময় একটা রিপোর্ট দেখে অবাক হলো। নিশির রক্তে ক্যান্সার কোষ গুলো কমতে শুরু করেছে। ডাক্তাররা সবাই অবাক। আর দুই দিন ধরে তারা অভজার্ব করল। দেখল আস্তে আস্তে রক্তে থাকা ক্যান্সার কোষ গুলো বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
তারা নিশির রক্ত নিয়ে ভালো ভাবে পরীক্ষা করা শুরু করল। এক বার, দুই বার, তিনবার। প্রতিবারই পজেটিভ রেজাল্ট।
নিশির রক্তে অটোমেটিক এন্টিডোট তৈরি হচ্ছে। ক্যান্সার কোষ গুলোকে ধ্বংস করছে। অসম্ভব কিছু দেখার সুভাগ্য হলো ডাক্তারদের। ডাক্তাররা এই এন্টিডোটের উৎস খুঁজতে গিয়ে আরো বেশি আচার্য হলো। এন্টিডোট এর উৎস হচ্ছে তার গর্বে থাকে বাচ্চাটি।
কি সুন্দর একটি ঘটনা, নিজেকে পৃথিবীতে আনার জন্য, নিজের অস্ত্বিত্তকে পৃথিবীতে জাহির করার জন্য নিজের ক্ষুদ্র শরীর থেকে তৈরি হলো ক্যান্সারের এন্টিডোট।
নিশি আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠল।
ডাক্তাররা নিশির শরীর থেকে এন্টিডোট নিয়ে তার DNA সিন্থেসিস করে নিল। এর থেকে নিশির শরীরে জন্মানো ক্যান্সারের প্রতিষেধক তৈরি করে নিল। যা দিয়ে এ রকম ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা করা যাবে। আর যার প্যান্টেন্ট তৈরি করা হলো নিশির ভবিষ্যৎ বাচ্চাটির নামে।