বাংলাদেশে অনেক গুলো ইকমার্স রয়েছে যেগুলো প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছে। এই ইকমার্স প্রতারণা নতুন কিছু না। বিগেস্ট স্ক্যাম লিখে সার্চ করলে পঞ্জি স্ক্যামের জনক Charles Ponzi এর নাম আসবে। পঞ্জি স্ক্যাম নতুন না। পুরাতন এই স্ক্যাম বার বার ফিরে আসে। খুব একটা চেঞ্জও নেই। আগা গোঁড়া প্রায় সেইম। এরপরও মানুষ এই ফাঁদে পা দেয়। কারণ? লোভ। তো অরিজিনাল পঞ্জি স্কিমের গল্প নিচে দিচ্ছি। পড়ে দেখবেন সেইম জিনিস। যা আজও হচ্ছে।
পঞ্জি স্কিমে একটা বিশাল গোষ্টির ক্ষতি হবেই হবে। স্কিমটাই এমন। তো যে এই পঞ্জি স্কিম চালায়, তার পরিণতিও প্রি ডিফাইন্ড। একদিন না একদিন ধরা খাবেই। তারা আগে থেকেই জানে যে ধরা খাবে। এরপরও মাঠে নামে। খেলে। লটারি। এই পর্যন্ত যতগুলো স্ক্যাম হয়েছে এমন, কারোই শেষ পরিণতি ভালো না। সমস্যা হচ্ছে তারা একা ডুবে না। অনেককে নিয়ে এক সাথে ডুবে।
প্রথম থেকেই যখন ইভ্যালি নিয়ে লিখতাম, অনেকেই অনেক কিছু বুঝিয়েছে। হয়তো ভেবেছে তাদের ক্ষতি করি। অথচ তাদের উপকার করার জন্যই লিখতাম। কেউ শুনেছে, কেউ শুনেনি। লেখাটা দ্বায়িত্ব ছিল। তাই লিখেছি। শুনা না শুনা অডিয়েন্সের উপর।
ইভ্যালির মত যে সব সাইট আছে, সেগুলো বন্ধ করে দিলেও নতুন রূপে আবার এসব আসবে। অন্য কেউ আনবে। আবার সবাই লোভে পড়বে। কারণ আমরা চাই কষ্ট না করে অনেক টাকা কামাতে। আর এরকম যত কিছুই দেখবেন, এমন লোভ যারাই দেখাবে, দিন শেষে তারা প্রতারক। দূরে থাকাই শ্রেয়। দূরে না থাকলে আপনি না ধরা খেলেও অন্য কেউ খাবে।
নিচের অংশ Ragib Hasan এর লেখা।
~ অল্প সময়ে বিশাল লাভ? চার্লস পনযি আর তার হায়-হায় ধান্ধা – Ponzi scheme ~
ষড়রিপুর বা মানুষের মাঝের ৬টি দোষের ৩ নম্বর রিপু হল লোভ। ধন সম্পদ ক্ষমতা টাকা পয়সা — এসবের লোভে মানুষ কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলে। আর এই লোভকে পুজি করেই যুগে যুগে বাটপারেরা ব্যবসা করে আসছে। এমনই একজন প্রতারক ছিলেন চার্লস পনযি। আর তার নামেই পরিচিত হয়েছে এই রকমের ধান্ধাবাজির ব্যবসাগুলো — পনযি স্কিম (Ponzi scheme) নামে।
পনযি স্কিমের কার্যকারিতা আসলে একই সবখানে। খুব অভাবনীয় লোভ দেখানো হয় আম জনতাকে। অল্প সময়ে বিশাল লাভ। দলে দলে লোকজন সেই প্রতারকের স্কিমে যোগ দেয়, টাকা ঢালে। বলাই বাহুল্য, পনযি স্কিমে টাকা বানানোর বা লাভ করার আসলে কোনই বাস্তব প্রক্রিয়া নাই। প্রথম দিকে যারা টাকা ঢালে, তাদেরকে লাভ দেয়া হয় পরে নতুন যারা যোগ দিচ্ছে, তাদের টাকা থেকে। লাভ পেয়ে প্রথম দিকের গ্রাহকেরা আরো মানুষের কাছে এই পনযি স্কিমের লাভের গল্প ফলাও করে বলে। আস্তে আস্তে ঝাঁকে ঝাঁকে লোভে পড়া মানুষেরা যোগ দেয়, টাকা ঢালে। তাদের টাকার সিংহভাগ যায় প্রতারকের পকেটে, বাকি অল্প কিছু দিয়ে শুরুর দিকের কাউকে কাউকে দেয়া হয়, বাকিদের আজ দিচ্ছি, কাল দিচ্ছি এমন আশা দেখানো হয়। টাকা আটকে গেছে যাদের, তারা আশায় ভর করে বসে থাকে। আর কেউ প্রতারকের এই প্রতারণা ব্যবসা বন্ধের কথা বললে এই প্রতারণার শিকারেরাই ফুঁসে উঠে
— তাদের টাকা উদ্ধার হবার অলীক আশায় তারা প্রতারককে আইনের হাত থেকে দূরে রাখতে চায়, যদি কখনো কোনভাবে টাকা ফেরত পাওয়া যায়!
চার্লস পনযির বাড়ি ইতালিতে। ১৯২০ সালে আমেরিকার বস্টনে শুরু করেন তার প্রতারণার ব্যবসা। তখনকার দিনে পোস্টার রিপ্লাই কুপন বলে এক রকমের কুপন কেনা যেত, যা এক দেশে কিনে অন্য দেশে বিক্রি করার উপায় ছিল। সেটা কেনা বেচার মাধ্যমে বিপুল লাভ করা যায়, এই গল্পটা পনযি সবার কাছে ছড়িয়ে দেন। তার পর দেখাতে শুরু করেন লোভ। তার এই ব্যবসায় টাকা ইনভেস্ট করলে ৪৫ দিনে ৫০% লাভ, অথবা ৯০ দিনে টাকা দ্বিগুণ হবে, এই আশা দেখান।
ব্যবসা শুরু হয় ১৯২০ এর ফেব্রুয়ারি থেকে। অল্প কয়েক সপ্তাহেই হাজার হাজার ডলার ইনভেস্ট করে লোভি মানুষেরা। পনযি মানুষের লোভ বাড়িয়ে আরো মুরগি ধরার জন্য পরের দিকের ইনভেস্টরদের টাকা নিয়ে প্রথম দিকের ইনভেস্টরদের এই বিশাল লাভ দেয়া শুরু করেন। অনেকেই টাকা দ্বিগুণ করে ফেলেছে, এই ব্যাপারটা দেখে আরো ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ যোগ দেয়। এভাবে মুহুর্মুহু বাড়তে থাকে পনযির জাল। মাত্র ৪ মাসের মাথায় ১৯২০ এর জুন নাগাদ মানুষ সে সময়ের হিসাবে ২৫ লাখ ডলার (এখনকার হিসাবে প্রায় ৩.২ কোটি বা ৩২ মিলিয়ন ডলার) ঢেলে দেয় পনযির ব্যবসায়। পনযি সবাইকে সেই লোভই দেখাচ্ছিল — টাকা দ্বিগুণ করে দিবে।
১৯২০ এর জুলাই মাসের শেষে পনজির ব্যবসা এতই ভাল হয়ে যায় যে সপ্তাহে ১ মিলিয়ন করে টাকা আসতে থাকে। টাকার প্রায় পুরোটাই যায় তার পকেটে। আসলে পনযির হাতে টাকা দ্বিগুণ করার কোন গোপন ব্যবসাবুদ্ধি আদৌ ছিল না। মাছের তেলে মাছ ভাজার মতই নতুনদের টাকায় পুরানোদের লাভ দেয়া, এইটাই করছিল। মানুষে লোভের কারণে বাড়িঘর বন্দক দিয়ে পর্যন্ত টাকা ঢালে পনযির ব্যবসায়। সেই টাকায় পনযি বাড়ি গাড়ি কিনতে থাকে, কাটায় বিলাসবহুল জীবন। আর তার কাছ থেকে সুবিধা বা টাকা পেয়ে তার সাফাই গাইবার লোকেরও অভাব হয়নি।
কেউ কেউ সন্দেহ করে বসে পনযির কাজকর্মে। এভাবে এই পরিমাণ লাভ দেয়া সম্ভব না, অংকের হিসাবেই, সেটা কেউ কেউ হিসাব করে দেখিয়ে দেয়। কিন্তু তাতে কী। পনযি নানা পত্রিকাকে পয়সা দিয়ে হাতের মুঠোয় ভরে নেয়, এমনকি সন্দেহের কথা বলার জন্য একজনের নামে মানহানীর মামলা করে জিতেও যায়। কিন্তু আস্তে আস্তে কর্তৃপক্ষের সন্দেহ বাড়তে থাকে। তদন্ত শুরু হয় পনযির বিরুদ্ধে। পনযির কোম্পানি আসলে বিপুল দেনায় আছে, তার কাছে কাস্টোমারেরা যে টাকা দিয়েছে, তার চাইতে তাদের পাওনা মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার বেশি, এটা হিসাবে বেরিয়ে আসে। ১৯২০ এর আগস্ট মাসে পনযির হায় হায় কোম্পানি বন্ধ হয়ে যায়। রাতারাতি পথে বসে হাজার হাজার মানুষ, যারা লোভের বশে তাদের কষ্টের টাকা তুলে দিয়েছিল এই প্রতারকের কাছে।
পনযি গ্রেপ্তার হন দ্রুতই। বিচারে তার জেল হয় বহু বছরের। কিন্তু লোভি মানুষদের টাকা আর ফেরত আসেনি — সেই ১৯২০ এর হিসাবে প্রায় ২০ মিলিয়ন ডলার (এখনকার হিসাবে প্রায় ২০০ মিলিয়ন বা ২০ কোটি ডলার) ক্ষতি হয়। প্রচুর মানুষ সব হারিয়ে পথে বসে। কেবল নিজেদের লোভই যার জন্য দায়ী।
পনযির গল্প এখানেই থামেনি, ১৯২৫ সালে জামিনে বেরিয়ে আবার প্রতারণার কাজ শুরু করেন পনযি। আবার জেলে যেতে হয়। ১৯৩৪ সালে জেল থেকে বেরুবার পরে আমেরিকা থেকে বহিষ্কার করা হয় তাকে। নিজ দেশ ইতালিতেও একই প্রতারণার ব্যবসা করতে গিয়ে পনযি ধরা পড়েন। তার পর ব্রাজিলে চলে গিয়ে সেখানেও একই রকমের কাজ করেন। কিন্তু শেষ জীবনটা চরম দারিদ্র্যে কেটেছে এই প্রতারকের। পরিশেষে নিঃস্ব অবস্থায় মারা যান পনযি। কিন্তু রেখে যান প্রতারণার এই কৌশল, যার নাম দেয়া হয়েছে Ponzi scheme। আজও দেশে দেশে প্রতারকেরা এই কৌশল খাটিয়ে মানুষের লোভকে কাজে লাগিয়ে সর্বনাশ করছে হাজার হাজার মানুষের।
এমনিই কি আর লোভকে ষড়রিপুর তৃতীয় রিপু ধরা হয়?