আমরা যারা ফ্রিল্যান্সিং করি, তাদের একটা গ্রুপ আছে Premier Professionals Club নামে। নাম প্রথমে ছিল আপওয়ার্ক প্রিমিয়ার ক্লাব। পরে কপিরাইট ইস্যু এবং অন্যান্য ফ্রিল্যান্সারদের যুক্ত করার জন্য এই নাম করা হয়। প্রতিবছরই এই ক্লাব থেকে ট্যুরের আয়োজন করা হয়। গত বছর করোনার কারণে কোন ট্যুর হয়নি। এই বছর তাই বড় আকারে একটা ট্যুরের আয়োজন করা হয়। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সুন্দরবন ট্যুরের।
যেহেতু সুন্দরবন লঞ্চে করে ঘুরতে হয়, আর লঞ্চে সিট সংখ্যা সীমিত, তাই রেজিস্ট্রেশনের সিস্টেম রাখা হয়। আগে যে রেজিস্ট্রেশন করতে পারবে, সেই যেতে পারবে এমন। কাঁপলদের জন্য প্রথমে রেজিস্ট্রেশন ওপেন করা হয়। আগে জানিয়ে দেওয়া হয় কখন রেজিস্ট্রেশন ওপেন হবে। সাথে সাথেই রেজিস্ট্রেশন করে নেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই সব সিট শেষ হয়ে যায়। এভাবে সিঙ্গেল যারা যাবে, তাদেরও সিত গুলো দ্রুত শেষ হয়ে যায়।
২৬ তারিখ সকালে আমরা ট্রেনে করে রওনা দেই খুলনার উদ্দেশ্যে। কেউ কেউ আগেই খুলনা চলে গিয়েছিল, খুলনা ঘুরে দেখার জন্য। আমাদের জন্য ট্রেনের স্নিগ্ধাতে টিকেট কাটলেও কোন একটা কারণে আমরা শোভন চেয়ারে যেতে হয়। এক্সট্রা একটা বগিতে। আর তা থাকে ট্রেনের একেবারে শেষের দিকে। ট্রেনে করে যেতে মজা লাগবে চিন্তা করেই ট্রেনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। কিন্তু এই নন এসিতে করে যেতে যেতে এত গরম আর বালিতে অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছে। তার উপর খুলনা ট্রেনে যেতে এত সময় লাগে। প্রায় ১০ ঘণ্টা লাগে। আমরা প্রায় ৯টার দিকে এয়ারপোর্ট স্টেশন থেকে উঠেছি, নেমেছি সন্ধ্যা ৭টার দিকে।
খুলনা নেমে আমরা চলে যাই ৬ নং ঘাটে। সেখান থেকে ট্রলারে করে লঞ্চে উঠি। লঞ্চে উঠতে একটু দেরি হয় হিসেব নিয়ে কোন একটা সমস্যার কারণে। ততক্ষণে ৯টা বেজে গিয়েছিল। সারাদিন এত বালি লেগেছে যে এক স্তর বালি লেগে ছিল গায়ে। তাই লঞ্চে উঠেই গোসল করে নেই। এরপর আমাদের রাতের খাবার সার্ভ করছিল। লঞ্চের উপরের ডেকে ডাইনিং স্পেস। চারপাশের ভিউ দেখার সাথে সাথে খাওয়া দাওয়া। দারুণ লাগে। প্রচণ্ড খিদে লেগেছিল। এরপর এক মগ চা নিয়ে ডেকে বসি। ততক্ষণে লঞ্চ ছেড়ে দিয়েছে সুন্দরবনের উদ্দেশ্যে। কিছুক্ষণ ডেকে থেকে পরে রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে নেই। সকালে উঠতে হবে।
সকালে নাস্তা খেয়ে আমরা হাড়বাড়িয়াতে নামি। লঞ্চ থেকে ট্রলারে করে হাড়বাড়িয়াতে নামিয়ে দেওয়া হয়। হাড়বাড়িয়াতে বনের ভেতর হাঁটার জন্য ট্রেইল করে দেওয়া আছে। সেখান দিয়ে আমরা হেঁটে সুন্দরবন দেখছিলাম। পশুর মধ্যে শুধু বানর দেখছিলাম এখানে। এখান থেকে ফিরে লঞ্চে উঠার পর হালকা নাস্তা সার্ভ করছিল। কি সুন্দর কলার ছড়া ঝুলিয়ে রেখেছে আমাদের জন্য। হাড়োবাড়িয়াতে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে গেলাম। তাই কিছুক্ষণ রুমে গিয়ে রেস্ট নিলাম। এরপর আমাদের দুপুরের খাবার সার্ভ করল। লঞ্চ চলছিল কটকার উদ্দেশ্যে। ভিউ দেখতে দেখতে খাওয়া দাওয়া করলাম।
বিকেল ৫টার দিকে আমরা কটকা পৌঁছাই। লঞ্চ থেকে নেমে কটকাতে হাঁটি। এখানে এত বেশি হরিণ। দুই পাশেই হরিণের পাল ছিল। এখানে টাইগার টিলা আছে। এই টাইগার টিলা হচ্ছে অন্য সব যায়গা থেকে একটু উঁচু। তাই জোয়ারের পানি উঠলে যখন সব দিক ডুবে যায়, তখন এখানে বন্য পশু গুলো আশ্রয় নেয়। আর তখন বাঘ শান্তি মত করে উদরপূর্তি করতে পারে। এরকম তিনটে টিলে আছে এখানে।
কটকা হাঁটাহাঁটি করে আমরা সন্ধ্যায় লঞ্চে ফিরে আসি। এক মগ চা নিয়ে ডেকে বসে চারপাশের সৌন্দর্য দেখি। বিশাল একটা চাঁদ উঠেছে। তার আলোতে সব কিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। ৯টার দিকে আমাদের রাতের খাবার সার্ভ করা হয়। খাওয়া দাওয়া করে কিছুক্ষণ ডেকে থেকে রুমের দিকে ফিরি।
আমাদের পাশের একটা রুমে একজন অসুস্থ হয়ে যায়। প্রথমে ভাবলাম সামান্য কোন অসুখ। পরে জানা গেলো উনি শ্বাস নিতে পারছেন না। রুম থেকে বের করে লঞ্চের সামনের দিকে নিয়ে যাই সবাই মিলে। এরপরও উনার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। কথা বলতে পারছিল না। যে টুকু কথা বলে, তা হচ্ছে উনাকে হসপিটালে নেওয়ার ব্যবস্থা করার কথা। আমরা সুন্দরবনের একবারে শেষ মাথায়। বঙ্গোপসাগরের পাশে। হসপিটাল অনেক অনেক দূরে। হসপিটাল নিতেও মিনিমাম ৮-১০ ঘণ্টা।
উনি বসে থাকতে পারছিল না। তাই সবাই মিলে ধরে কনফারেন্স রুমে নিয়ে যাওয়া হয় উনাকে। এর মধ্যে উনাকে এলার্জির ঔষধ খাওয়ানো হয়। এছাড়া আমাদের একজনের কাছে ইনহেলার ছিল। তাও দেওয়া হয়। কিছুই হচ্ছিল না। এর মধ্যে উনি কথাই বলতে পারছিল না। চেতনা হারিয়েছে।
সবাই দুশ্চিন্তায় আমরা। কি ট্যুর করবে। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ট্যুর ক্যানসেল করে ফিরে যাওয়া হবে। লঞ্চ ঘুরিয়ে মঙ্গলার দিকে রওনা হলাম আমরা। এর মধ্যে ৯৯৯ এ কল করা হয়েছে। তারা জানালো কোস্টগার্ড রওনা দিয়েছে। কোথায় থেকে রওনা দিয়েছে, কতক্ষণ লাগবে এসবের কিছুই জানানো হয়নি। অনেকক্ষণ পরও কোস্ট গার্ডের কোন খবর নেই।
আমরা সবাই যে যে ভাবে পারি, চেষ্টা করছিলাম। একজন ডাক্তারের সাথে ভিডিও কলে কথা বলে কি কি করতে হবে, তা জেনে নিল। এভাবে সবাই চেষ্টা করতেছিল।
রাত ১টার দিকে উনার অবস্থা একটু ভাল হলো। উনি বলল উনি এখন শ্বাস নিতে পারছেন। যেহেতু উনি ভালো ফীল করছেন, তাই আমরা ভেবেছি কোস্টগার্ড আসলে উনাকে হসপিটাল পাঠিয়ে দিব। কিন্তু কোস্ট গার্ড আসে নাই বা আমাদের খুঁজে পায়নি। যদিও একটাই মাত্র পথ। খুঁজে পাওয়ার কথা। কোস্ট গার্ড না আসায় আমরা আবার মঙ্গলার দিকে রওনা দিলাম। উনাকে আগে হসপিটালাইজড করতে হবে।
যদিও আমাদের কটকা থাকার কথা ছিল, সেখানে নেমে ঘুরাঘুরি এবং বীচে খেলাধুলা করার কথা ছিল। মানুষের জীবন থেকে তো ঘুরাঘুরি বড় হতে পারে না। তাই ঐসব বাদ দেওয়া হয়েছে।
সকালে যখন মংলা পৌঁছাই আমরা, উনাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সকালের নাস্তা খেয়ে নেই আমরা। লঞ্চে হাঁটাহাঁটি করি, কেউ কার্ড খেলে, কেউ গল্প করে। এভাবেই সময় গুলো কাটিয়ে দিচ্ছিল। দুপুর হলে আবার খাওয়া দাওয়া করি। এরপর বিকেলের দিকে আমরা করমজল নামি। এখানে অনেক হরিণ রয়েছে। যেগুলোকে খাবার দিলে কাছে আসে। খাবার কিনতে পাওয়া যায়। রয়েছে অনেক কুমির। এছাড়া বনের মধ্যে হাঁটার জন্য রয়েছে ট্রেইল। এই বনে অনেক বানর রয়েছে। বানর যদি জানতে পারে পারে আপনার কাছে কোন খাবার আছে, তাহলে আপনার খবর আছে। আক্রমণ করবেই করবে। আমাদের সাথে কয়েক জনকেই আক্রমণ করেছে।
সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা করমজল থাকি। এরপর লঞ্চে ফিরে আসি। লঞ্চ ঢাংমারি খালে রাখা হয়। দুই পাশে কিছু ঘরবাড়ি রয়েছে। রাতে লঞ্চে সাউন্ডবক্সে গান চালানো হয়। যখন গান চালানো হয়, দুই পাশের বাচ্চারা গানের সাথে সাথে নাচতেছিল। পূর্নিমার চাঁদ উঠেছে। দুই পাশ কি সুন্দর আলোকিত হয়ে উঠেছে।
রাতে আমাদের জন্য চিকেন এবং ফিস বার-বি-কিউ করা হয়। খাওয়া দাওয়া করে লঞ্চের ডেকে বসে চাঁদের আলো দেখি। একসময় ঘুম আসলে ঘুমাতে যাই।
সকালে উঠে ঢাংমারি গ্রামে যাই। এর দুই পাশেই নদী। চিকন করে একটা গ্রাম। যে কোন সময় নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে। এখানে একটা প্রাইমারি স্কুলও দেখলাম। বাজারও আছে সামনে, ততদূর যাওয়া হয়নি আমাদের। এই গ্রামে খাবার পানি পাওয়া যায় না। অনেক গভীর নলকূপ থেকেও লবণাক্ত পানি বের হয়। তাই অনেক দূর থেকে পানি আনতে হয়। আর বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে রেখে তারপর ব্যবহার করে। লঞ্চে ফিরে নাস্তা করে নিলাম। এরপর কিছুক্ষণ রেস্ট করলাম। দুপুরে উঠে ফ্রেশ হয়ে ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। দুপুরের খাবার খেয়ে লঞ্চ থেকে নেমে গেলাম। যে যার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছি এরপর।
কেউ বাসে, কেউ এয়ারে ফিরবে। আমরা কয়েকজন ট্রেনে ফিরব। রাত ১০টার দিকে ট্রেন। ভাবলাম খুলনা একটু ঘুরে নেই। প্রান্ত বিশ্বাস আমাকে মেসেজ দিয়েছিল দেখা করবে বলে। লঞ্চ ঘাটে এসেছে। এরপর ওর বাসায় ব্যাগ রেখে খুলনা ইউনিভার্সিটির দিকে যাই। আমার মামাতো ভাই ফয়সাল ঐখানে ছিল। ইসলাম নগর রোডে বসে ফ্রেস জুস খেয়ে নেই। এর মধ্যে শুভ্র এবং মাসনুন ভাইকে কল দেই। উনারা আসলে এক সাথে বসে গল্প করি। সন্ধ্যার পর রাজ মহল ফুড কোর্টে যাই আমরা। নাস্তা করি এক সাথে বসে। খাওয়া দাওয়া রেল স্টেশন ফিরি। ঐখানে দেখা হয় রকিবুল ভাই এর সাথে। উনি এক সেট দোয়ার স্টিকার দেয়।
১০.২০ এ ট্রেন ছাড়ল। ট্রেনের সমস্যা হচ্ছে লাইট বন্ধ না করা। ঘুমানোর উপায় নেই। এরপরও কিভাবে না কিভাবে জানি ঘুমিয়ে নিলাম। ৭টার দিকে আমাদের এয়ারপোর্ট স্টেশনে নামিয়ে দেয়। যাওয়ার সময়ের মত কষ্ট হয়নি। আরামেই ঢাকায় পৌঁছাই। আলহামদুলিল্লাহ্।
এর আগেও একবার সুন্দরবন যাওয়ার সুযোগ হয়। ঐটাও অনেক সুন্দর একটা ট্যুর ছিল।