দ্বীপ রাষ্ট্র শ্রীলংকা ভ্রমণ

শ্রীলংকায় প্রথম দিন

আমরা ফেব্রুয়ারীর ৫ তারিখে মালদ্বীপ যাই। মালদ্বীপ যেতে এবং আসতে শ্রীলংকাতে ট্রানজিট নিতে হয় ৩ ঘণ্টার মত। তো ভাবলাম যেহেতু শ্রীলংকায় নামবই, তাহলে মালদ্বীপ ঘুরার পর শ্রীলংকাও ঘুরে যাই। এরপর ঐ ভাবেই আমরা টিকেট কেটে নিয়েছিলাম। ৮টারিখ বৃহস্পতিবার আমরা মালদ্বীপ থেকে শ্রীলংকার উদ্ধেশ্যে বিমানে উঠি। শ্রীলংকায় পৌঁছাই বিকেলের দিকে। মালদ্বীপ থেরকে মাত্র এক ঘন্টার ফ্লাইট। শ্রীলংকায় অন এরাভাল ভিসা পাওয়া যায়। তার জন্য ২৫ ডলার পে করতে হয়। পেমেন্ট বুথে আমরা পে করে চলে গেলাম ইমিগ্রেশনের দিকে। পে করার সময় জিজ্ঞেস করেছিল কত দিন থাকব, কবে রিটার্ণ করব ইত্যাদি। তখন আমাদের রিটার্ণ টিকেটটি দেখেছে।

শ্রীলংকায় থাকার জন্য রুম Airbnb দিয়ে বুক করেছিলাম ঐ দিনই। তারা তখনো এপ্রুভ করেনি। আর এপ্রুভ না করলে হোটেলের সঠিক এড্রেস পাওয়া যায় না। কিন্তু ইমিগ্রেশন ফরমে কোথায় থাকব, সে এড্রেস দিতে হয়। এটা যে কোন দেশের জন্যই। আমরা Airbnb তে যে এড্রেস পেয়েছি, ঐটাই দিয়েছি। ভাবতেছিলাম আবার হোটেলের জন্য কোন ঝামেলা করে কিনা। ইমিগ্রেশনে দেখলাম কিছুই জিজ্ঞেস করেনি। পাসপোর্ট দিলাম, ভিসা এবং এরাইভাল সীল মেরে দিল। ওদের ভিসা হচ্ছে একটা ছোট্ট স্টিকার। এই তো শেষ! আমরা এয়ারপোর্ট থেকে বের হলাম।

এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে আমাদের প্ল্যান ছিল কলোম্বো যাওয়ার। ট্যাক্সি, উবার বা বাসে যাওয়া যায়। এয়ারপোর্ট থেকে বের হলেই বাস স্ট্যান্ড। আমরা বাসে উঠে পড়লাম। ততক্ষণে সব অন্ধ্যকার হয়ে গিয়েছে। প্রায় এক ঘন্টা লাগল কলম্বো পৌঁছাতে।

Airbnb তে রুম তখনো এপ্রুভ না করার কারণে ঐ রিকোয়েস্ট পরে আমরা ক্যানসেল করে দেই। নিজেরা হোটেল খুঁজতে থাকি। অনেক গুলো হোটেল ছিল মূল শহরে। তেমন একটা পছন্দ না হওয়ায় বীচ সাইডে চলে যাই। ঐখানে অনেক সুন্দর সব হোটেল রয়েছে। বীচ সাইডেই রয়েছে ওদের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন সহ সব সরকারী প্রতিষ্ঠান। এছাড়া চোখে পড়ছিল সুন্দর সুন্দর সব বিল্ডিং। লাইটিং করে রাখার কারণে রাতের বেলা খুব সুন্দর লাগছিল।

কলম্বো ওদের রাজধানী হওয়া সত্বেও জ্যাম খুব একটা চোখে পড়েনি। আমরা বীচ সাইডে এসে প্রথমে ম্যাকডোনাল্ডে ঢুকে রাতের খাবার খেয়ে নেই। এরপর একটা হোটেলে উঠে পড়ি। গান শুনতে শুনতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ি।

শ্রীলংকায় দ্বিতীয় দিন – শুক্রবার

সকালে রুম থেকে বের হই সাড়ে দশটার দিকে। কেএফসিতে গিয়ে সকালের নাস্তা করে নেই। পাশেই ছিল বারিস্তা। ভালো কফিশপ দেখলে কফি না খেয়ে আর কোন দিকে যেতে ইচ্ছে করে না। কফিশপে বসে কফি খেলাম। কোথায় কোথায় আমরা যাবো, সে প্ল্যান করলাম। এরপর রওনা দিলাম রাম্বুক্কানা (Rambukkana) নামক জায়গার দিকে। ট্রেনে করে। প্রায় তিন ঘন্টা লাগল। এক্সপ্রেস ট্রেন ছিল, তাতে করে গেলে আরো দ্রুত পৌছানো যেতো। যদিও তা পরে জানলাম।

ট্রেনে লোকালদের সাথেই কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম। এরপর যাত্রী কমে যাওয়ার পর বসার সুযোগ পেলাম। ট্রেনে কিছুক্ষণ পর পর কমলা এবং আপেল বিক্রি করছিল। প্রথমে কমলা কিনে খেলাম আমরা। এরপর আপেল। আপেল কেনার পর কেটে লবন মরিচ মিশিয়ে দিয়েছিল। খেতে দারুণ লেগেছে। এই প্রথম লবন মরিচ দিয়ে আপেল খেলাম।

রাম্বুক্কানা থেকে ট্যাক্সিতে করে চলে গেলাম Pinnawala Elephant Orphanage এ। জঙ্গলে দলচ্যুত হাতি এবং হাতির বাচ্চাদেরকে এখানে এনে লালন পালন করা হয়।

এলিফ্যান্ট অরফানেজ এ ঢুকতে টিকেট কাটতে হয়। সার্ক ট্যুরিস্টদের জন্য ৭৫০ রুপি। পাশেই একটা চিড়িয়াখানা রয়েছে। চিড়িয়াখানা এবং অরপানেজ এক সাথে টিকেট ১০০০ রুপি। আমরা চিড়িয়াখানায়ও যাবো, তাই এক সাথে টিকেট কেটে নিলাম।

এখানে অনেক গুলো হাতি রয়েছে। হাতিদের পরিচর্যা করার জন্য রয়েছে অনেক গুলো ঘর। যে সব হাতি সুস্থ এবং সবল হয়ে উঠে সেগুলোকে আবার বনে ছেড়ে দিয়ে আসা হয়। এখানে অনেক কাঠবিড়ালও রয়েছে। এগুলো অনেক ছোট। এত দ্রুত দৌঁড়াদৌঁড়ি করে যে ঠিক মত ছবি তোলা যায় না। নিজেদের মত করে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যায়।

মাহুতিরা হাতি নিয়ে পিরছে।

হাতি দেখে আমরা বের হলাম। তখন প্রায় ৩টা। খেতে হবে। পাশেই একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে অর্ডার দিলাম। ওরা বলল ২০ মিনিট লাগবে। লাগল ১ ঘন্টা। খাওয়া দাওয়া করে বের হলাম। চলে গেলাম চিড়িয়াখানায়। কাছেই।

চিড়িয়াখানা ঘুরে দেখানোর জন্য গাড়ি পাওয়া যায়। এক হাজার রুপি দিয়ে। গাড়িতে করে আমাদের বিভিন্ন প্রাণী দেখাতে লাগল। দেখে বের হলাম। পরবর্তী গন্তব্য ক্যান্ডি। ক্যান্ডি নাকি বিখ্যাত শহর। ট্রেন স্টেশনে এসে টিকেট কেটে নিলাম।

ক্যান্ডি হচ্ছে পাহাড়ের উপর। আর এখানের রেল লাইন হচ্ছে পাহাড়ের উপর দিয়ে। মাঝে মাঝে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে ক্যানেল রয়েছে, সেই ক্যানেলের মধ্য দিয়ে ট্রেইন লাইন। ক্যানেলের ভেতর দিয়ে যখন প্রথমবার ঢুকল, তখন একটা ভয় লাগা কাজ করল। হুট করে সব অন্ধকার হয়ে যাওয়ার কারণে। পরে সব সময় একটা ভালো লাগা কাজ করছিল।

ক্যান্ডিতে পৌছিয়েছি সন্ধ্যার পরে। এখানে কেএফসিতে ঢুকে খাবার খেয়ে নিলাম। এরপর ট্যাক্সি নিয়ে রওনা দিলাম আমাদের হোটেলের দিকে। হোটেল Airbnb তে বুক দেওয়া হয়েছে। এটা মূল শহরের একটু বাহিরে। রাত হওয়াতে কিছু একটা দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু এর রিভিউ অনেক ভালো দেখেই এখানে আসা।

এখানে এসে দেখলাম আমাদের হোস্ট অনেক ফ্রেন্ডলি। আসার পরই আমাদের চা অফার করল। আমাদের যা যা দরকার, সব দিল। এবং কোন সমস্যা আছে কিনা সব জানালো। রুমটি খুবি সুন্দর। সব কিছুই সুন্দর করে সাজানো গোছানো।

হোস্ট কিছুক্ষণ পর এসে সকালে আমরা ব্রেকফাস্ট খাবো কিনা, তা জিজ্ঞেস করল। Airbnb তে এদের ব্রেকফাস্টের ভালো রিভিউ দেখলাম। তাই আমরাও অর্ডার দিলাম। মাত্র ৫ ডলার জন প্রতি।

সকালে উঠ ফ্রেশ হয়ে নেওয়ার পর আমাদের নাস্তা দিল। ৫ ডলারে এত সুন্দর নাস্তা হতে পারে, না দেখলে কেউ বিশ্বাস করতে চাইবে না। এত গুলো আইটেম। সব গুলোই দারুণ টেস্টি। কি সুন্দর করে সার্ভ করে আমাদের ডাকল। সাজিয়ে রাখাটাও দেখার মত।

পাঁচ ডলারের নাস্তা

টেবিলে যা দিয়েছে, এর পরও অনেক গুলো আইটেম আমাদের সার্ভ করল। এরপর চা দিল এবং শেষে দিল ডেজার্ট হিসেবে ফল। গ্রীষ্মকালীন ফল।

খাওয়া দাওয়া করে আমরা বের হয়ে পড়লাম। আমরা চলে গেলাম ক্যান্ডি বাস স্ট্যান্ড। শ্রীলংকায় উবারের পাশা পাশি পিক-মি নামক সুন্দর একটা সার্ভিস রয়েছে। যেখান থেকে টুকটুক, ন্যানো বা যে কোন গাড়িই দিয়েই ভ্রমণ করা যায়। পিক-মিতে দেখলাম আমাদের লোকেশন থেকে বাস স্ট্যান্ড যেতে মাত্র ১২০ রুপির মত লাগবে। আমরা লোকাল একটা টুকটুক ডাকলাম। ও বলল ২৫০ রুপি। আমরা বললাম ১৫০ রুপি দিব। রাজি হয়েছে নাকি হয়নি বুঝলাম না। আমাদের উঠতে বলল, আমরা উঠে পড়লাম। এরপর যখন বাস স্ট্যান্ড নেমে ১৫০ রুপি দিলাম, তখন ও বলল ২৫০ রুপি দিতে। ১৫০ রুপি নিবেই না। পরে আমরা ২৫০ রুপিই দিলাম। অথচ আগের রাতে ট্রেন স্টেশন থেকে ন্যানোতে করে গিয়েছি মাত্র ১৮০ রুপিতে। শ্রীলংকা যত গুলো লোকাল টুকটুক দেখলাম, সবাই প্রায় একই রকম। বিদেশী বুঝে উল্টা পাল্টা ভাড়া চেয়ে বসে। পিক-মি অ্যাপ ব্যবহার করলে সুন্দর মত কম খরচেই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়া যায়। বাস স্ট্যান্ড থেকে আমরা যাবো নুয়ারা এলিয়া ( Nuwara Eliya ) নামক জায়গায়। কিছুক্ষণ বাস স্ট্যান্ডে বসার পর একটা কোস্টার আসল। আমরা উঠে পড়লাম। দেখলাম অনেকেই ট্যুরিস্ট। রওনা দিলাম নুয়ারা এলিয়ার দিকে। পাহাড়ি রাস্তা। দুই পাশে বাড়ি ঘর। পাহাড়ের গাঁ ঘেশে আমরা উঠতে লাগলাম উপরের দিকে।

পাহাড়ি রাস্তা এবং চা বাগান

নুয়ারা এলিয়াতে নাকি চায়ের মিউজিয়াম রয়েছে। ঐখানে গিয়ে জানলাম মিউজিয়ামটি বন্ধ। কারণ? আজ তাদের নির্বাচন হচ্ছে। পুরা শ্রীলংকাতেই অনেক চা বাগান রয়েছে। কিন্তু এই নুয়ারা এলিয়াতে অনেক সুন্দর কিছু চায়ের বাগান রয়েছে। এখানে গিয়ে আমরা গেলাম Damro নামক একটা কোম্পানির Tea Lounge এ। এখানে চায়ের ফ্যাক্টরিও রয়েছে। তাছাড়া জায়গায়টা অনেক সুন্দর করে সাজানো। বসার জায়গা রয়েছে। যেখান থেকে চা বাগানের সুন্দর ভিউ পাওয়া যায়।

নুয়ারা এলিয়া থেকে আমরা রওনা দিলাম হাটনের দিকে। গন্তব্য এডাম’স পীক। যেখানে হযরত আদম আঃ এর পায়ের চাপ রয়েছে। আমাদের প্ল্যান ছিল পরের দিন সকালে এডাম’স পীকে যাবো। কারণ হাটনে পৌছাতে পৌছাতে রাত হয়ে গিয়েছিল। বাসে দেখলাম আরো দুইজন ট্যুরিস্ট। যখন শুনল আমরা এডাম’স পীকে যাবো, তারা বলল তারাও এডাম’স পীকে যাওয়ার জন্য এসেছে। তারা জানালো তারা রাতেই যাবে। সকালে সূর্যদয় দেখবে সেখানে। দুইজন মেয়ে হয়ে এর রাতে ট্র্যাকিং করবে। আর আমরা ঘুমিয়ে থাকব? হতেই পারে না। আমরাও রওনা দিলাম এডাম’স পীকের উদ্দেশ্যে।

হাটনে নেমে একটা মাইক্রোতে উঠে আমরা রওনা দিলাম। আমাদের নামিয়ে দিল এডাম’স পীকে উঠার শেষ রাস্তায়। ঐখানে গিয়ে দেখি হুলুস্থুল কান্ড। রাত মনেই হয় না। সব আলোকিত। হাজার হাজার ট্যুরিস্ট। সবাই এই রাতেই রওনা দিচ্ছে এডাম’স পীকের উদ্দেশ্যে। যারা আগে গিয়েছে, তারা ফিরে এসেছে। রাত ২টার দিকে রওনা দিলে সকালে সূর্যদয়ের আগে পৌঁছানো যাবে। আমরা যখন পৌছেছি তখন রাত ১০টার মত। এখনো ৪ ঘন্টা সময় আছে। ভেবেছি হোটেলে একটা রুম নিয়ে রেস্ট নিব কিছুক্ষণ। কিন্তু দেখা গেলো অনেক বেশি টাকা লাগবে। পরে চিন্তা করলাম চারদিক ঘুরেই কাটিয়ে দিব।

শ্রীলংকার কলোম্বো বা অন্যান্য যায়গায় শীত ছিল না। উল্টো গরম লেগেছিল। পাহাড়ের দিকে যত যেতে লাগলাম, তত বেশি শীত লাগতে লাগল। এখানে প্রচুর শীত। আমরা যে জামা কাপড় নিয়ে গিয়েছি, তাতে শীত মানছিল না। পরে ঐখান থেকে সবাই শীতের জামা কিনে নিলাম। এরপর একটা দোকানে কফি খেয়ে আড্ডা দিতে লাগলাম। আমাদের সাথে ছিল বাসে দেখা হওয়া মেয়ে দুইটি। তারা এসেছে ইউক্রেন থেকে। ইউক্রেনে এখন অনেক ঠান্ডা। ঠান্ডা থেকে বাঁচার জন্যই শ্রীলংকায় আসা। দুই মাস থাকবে শ্রীলংকায়। এক মাসের মত ছিল। সামনে আরো এক মাস থাকবে। এটা সেটা নিয়ে গল্প করতে করতে ২টা বেজে গেলো। আমরা রওনা দিলাম এডাম’স পীকের উদ্দেশ্যে।

আমি জীবনে অনেক পাহাড়ে ট্রেকিং করেছি, তাই ভয় পাচ্ছিলাম না। রাতের বেলা, ঠিক মত ঘুম না যাওয়ার কারণে একটু পর পরই টায়ার্ড হয়ে যাচ্ছিলাম। তখন একটু রেস্ট নিয়ে আবার রওনা দিচ্ছিলাম। সাধারণত আগে ট্রেকিং করেছি কোন ব্যাকপ্যাক ছাড়া। এই প্রথম বিশাল একটা ব্যাকপ্যাক পিঠে। তাই কষ্ট একটু বেশি হচ্ছিল।

কত শত মানুষ যে উঠছে উপরের দিকে। কেউ কেউ ছোট বাচ্চা নিয়ে, কেউ ক্র্যাচ নিয়ে, কেউ দুই পায়ে সমস্যা নিয়ে, বুড়া, বাচ্ছা সবাই উঠতেছিল। লোকাল শ্রীলংকার অনেক মানুষ, সাথে প্রচুর টুরিস্ট। তাই কষ্ট হলেও একটু রেস্ট নিয়েই উপরের দিকে উঠতে লাগলাম।

ব্লগে জানলাম ৩ ঘন্টার মত ট্র্যাক করলে পীকে পৌছানো যাবে। এই তিন ঘন্টা হচ্ছে রেস্ট নেওয়ার সময় ব্যতিত। অর্থৎ একটানা তিন ঘন্টা ট্র্যাকিং করার মত ট্রাক। রেস্ট নেওয়া সহ সময় আরো বেশি লাগে।

ট্রেক করার পুরা পথেই সিড়ি করে দেওয়া। আর দুই পাশে রয়েছে অনেক দোকান। মাঝে মাঝে বসে আমরা কফি বা স্ন্যাক্স খেয়ে নিলাম। উপরে উঠে যখন দেখলাম এডাম’স পীক আর একটু বাকি, তখন একটা দোকানে বসে রেস্ট নিলাম। ঘুম পাচ্ছিল খুব। হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে নিলাম কিছুক্ষণ। আমরা যখন ট্রেকিং শুরু করেছি, তখন এক সাথে শুরু করলেও এরপর এক জন এক এক জায়গায় রয়ে গিয়েছে। কেউ আগে কেউ পরে। আমি ঘুম থেকে জেগে দেখি পাশে রাসেল ভাই। আর বাহিরে তাকিয়ে দেখি অনেক মানুষ পাহাড়ের এক চূড়ায় দাড়িয়ে রয়েছে, তাদের মুখে রঙ্গিন আলো পড়ছে। বুঝলাম সূর্য উঠতেছে। দ্রুত উপরের দিকে উঠতে লাগলাম। পূর্বদিক কেমন রঙ্গিন হয়ে উঠল। পাহাড়ের চূড়া থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি মেঘে সব কিছু ডেকে রয়েছে। আমরা মেঘেরও উপরে। তাপমাত্রা -১ বা এমন কিন্তু ঐ দিকে খেয়াল নেই। পূর্বদিকে তাকিয়ে সব কষ্ট ভুলে গেলাম।

মেঘে ঢাকা পাহাড়

নতুন আরেকটা দিন। শ্রীলংকায় আমাদের তৃতীয় দিন। শনিবার।

সূর্যমামা আস্তে আস্তে ঊঁকি দিতে লাগল। এডাম’স পীক আরো অনেক উপরে, কিন্তু উপরে উঠার আর জোগাড় নেই। সিঁড়িতে মানুষ গিজগিজ করছে। আদম আঃ এর পা দেখার জন্য সবাই উপরে উঠতেছে। লাইন সামনে এগুচ্ছে না। অনেক আস্তে আস্তে এগুচ্ছে। এতটুকু উঠেছি এখন যদি পায়ের চাপ দেখে না যাই, নিজের কাছেই কেমন লাগবে। তাই লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। একটু একটু করে উপরের দিকে উঠলাম। প্রায় দুই ঘন্টা পরে আদম আঃ এর পায়ের চাপ দেখার সুযোগ হলো। সমস্যা হচ্ছে পায়ের চাপ কাপড় দিয়ে ঢাকা। আর ঐখানে সবাই টাকা ফেলছিল। কেউ কেউ সেজদাও করছিল। বিশাল পায়ের চাপ বুঝা যাচ্ছিল। দেখে নামতে শুরু করললাম।

এডাম’স পীকে সূর্যদয়

ব্যাকপ্যাক নিয়ে নামতেও কষ্ট হচ্ছিল। নামতে তো হবে। আস্তে আস্তে নামলাম। নেমে রাসেল ভাই এবং নাহিদ ভাই এর জন্য অপেক্ষা করলাম। উনারা ফিরলে আমরা ঐখানে একটা রেস্টুরেন্টে খেতে বসলাম। ভাতিজা হোটেল সম্ভত নাম। এমন বিস্বাদ খাবার জীবনে খাইনি। খাবারের পাশাপাশি ওদের সার্ভিসও জগন্য ছিল। আর বিল? ঐটাকা দিয়ে শ্রীলংকার অন্য কোথাও দুই বার ভালো মানের খাওয়া যেতো। রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে বাসে উঠলাম। গন্তব্য হাটনে।

এডাম’স পীক থেকে নিচের বাড়িঘর

পরের দিন সকালে আমাদের ফ্লাইট। কলোম্বো পৌঁছাতে হবে। হাটন থেকে কলম্বো ট্রেন রয়েছে। ট্রেন স্টেশনে গিয়ে দেখলাম কোন সীট নেই। ৫ ঘণ্টার মত রাস্তা। দাঁড়িয়ে যাওয়ার মত টিকেট পাওয়া যাবে। বাসও রয়েছে হাটন থেকে কলোম্বোতে। বাস স্টেশনে চলে গেলাম আবার। গিয়ে দেখলাম বাসও নেই কোন। আবার বাসে উঠার জন্য বিশাল লাইন। এই লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলাম প্রায় দুই ঘন্টা! এরপর যখন বাসে উঠার সুযোগ পেলাম, তখন দেখলাম বাসে সিট নেই। নেমে আবার পরের বাসের জন্য অপেক্ষা করলাম। বাস স্টেশন এসেছি আমরা আড়াইটার দিকে। ৫টার দিকে বাসে উঠার সুযোগ পেলাম। এরপর আস্তে আস্তে রওনা দিলাম কলোম্বোর দিকে। শ্রীলংকার অন্য কোন এলাকায় এরকম বাসের সমস্যা হয়নি। যেখানেই গিয়েছি, সহজেই বাস বা ট্রেন পেয়ে গিয়েছি। এখানে কি হলো বুঝলাম না।

আজ তাদের নির্বাচনের রেজাল্ট দিচ্ছিল। গতকাল নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু সব কিছু কি সুন্দর করেই না চলছিল। কত ট্যুরিস্ট, সবাই নিশ্চিন্তে ঘুরাঘুরি করছিল। আর আমাদের নির্বাচনের কথা চিন্তা করলেই কেমন ভয়ঙ্কর কিছু চিত্র মনে ভেসে উঠে।

পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে বাস চলছিল। বাহিরে সুন্দর ভিউ। কিন্তু ঘুমের জন্য অন্য কোন দিকে নজর দেওয়ার সুযোগ ছিল না। বাস গুলো হচ্ছে আমাদের BRTC বাসের মত। ঘুমানোর কোন সুযোগ নেই। তারপরও কিভাবে না কিভাবে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এক সময় কলোম্বো পৌঁছাই। তখন সময় রাত দশটা। আমাদের ফ্লাইট সকাল সাড়ে সাতটার দিকে। হোটেলে উঠলে মাত্র ৪ ঘন্টার মত সময় পাবো। চিন্তা করলাম এয়ারপোর্টের দিকে চলে যাই। এয়ারপোর্টে গিয়েই একটু রেস্ট নিয়ে নিব। তার আগে আমাদের খেতে হবে।

ম্যাকডোনাল্ডসে খাবো চিন্তা করলাম। তা আবার বাস স্ট্যান্ড থেকে একটু দূরে। বীচ এলাকায়। ট্যাক্সি নিয়ে চলে গেলাম ম্যাকডোনাল্ডসে। এরপর খাওয়া দাওয়া করে নিলাম আমরা। ম্যাকডোনাল্ডস থেকে বের হয়ে একটা সুপার শপে ঢুকলাম। ততক্ষণে এগারোটা বাজে। তারা ক্লোজ করে দিবে। আমরা বললাম ৫ মিনিট সময় নিব। এরপর রাসেল ভাই এবং নাহিদ ভাই চকলেট এবং অন্যান্য কিছু কিনল বাড়ির জন্য। আবার আমাদের কাছে রুপিও শেষ। সুপার শপে না হয় কার্ড দিয়ে পে করা যাবে। কিন্তু এয়ারপোর্ট যাওয়ার বাস ভাড়া তো দিতে হবে রুপিতে। আমাদের কাছে ডলারও ছিল আবার কার্ড দিয়েও টাকা তুলতে পারতাম। সমস্যা হচ্ছে আমাদের শুধু দরকার কলোম্বো থেকে এয়ারপোর্ট যাওয়ার ভাড়া। চকলেট কেনার পর বললাম এক্সটা ১০০০ রুপি বেশি চার্জ করতে, তারপর আমাদের ১০০০ রুপি ক্যাশ দিতে। ওরা দিতে রাজি হলো। বাংলাদেশের কোন শপে ঢুকে এমন আবদার করলে সম্ভত লাঠি নিয়ে দৌঁড়ানি দিত।

শপিং শেষে বের হয়ে ট্যাক্সি নিয়ে চলে গেলাম বাস স্ট্যান্ডে। ট্যাক্সি ড্রাইভার সুন্দর মত আমাদের এয়ারপোর্টে যাওয়ার বাসে তুলে দিল। এই ট্যাক্সিটি লোকাল হলেও মিটারে এসেছে। ব্যবহারও দারুণ ছিল। প্রায় দেড়টার দিকে পৌছালাম আমরা এয়ারপোর্টে।

এয়ারপোর্টে ঢুকে দেখলাম অনেক ট্রাভেলার যে যেখানে সুযোগ পেয়েছে, সেখানে ঘুমাচ্ছে। আমাদের চেক ইন এখনো দেরি আছে। তাই তোয়ালে বিছিয়ে মাথার নিচে ব্যাগ দিয়ে ঘুমিয়ে নিলাম কিছুক্ষণ। ৫টার দিকে উঠে বোর্ডিং পাস নিলাম। ইমিগ্রেশন শেষ করে এরপর ট্রানজিট লাউঞ্জে অপেক্ষা করলাম। চেক ইনের সময় হলে চেক ইন করে বিমানে উঠলাম। যত ভালো ট্যুরই হোক না কেনো, শেষ দিকে বাড়ির প্রতি একটা টান কাজ করে। অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন দেশে এসে নামতে পারি।

শ্রীলংকা খুবি ট্রাভেলার ফ্রেন্ডলি একটা দেশ। আমি জানি না কেন বাংলাদেশ থেকে শ্রীলংকায় মানুষ ঘুরতে কম যায়, কিন্তু গিয়ে দেখলাম শ্রীলংকা অনেক সুন্দর একটা দেশ। ট্রাফিক জ্যাম নেই বললেই চলে। ট্রাভেলারদের জন্য সব ব্যবস্থা রয়েছে। এমনকি রয়েছে প্রচুর ট্রাভেলারও। খরচ বাংলাদেশ থেকেও অনেক কম। খাবার দাবার, হোটেল ভাড়া সব কিছুই অনেক সাশ্রয়ী। আর মানুষ গুলোও অনেক ফ্রেন্ডলি। শ্রীলংকা থেকে ভালো লাগা নিয়েই ফিরলাম। নিজ দেশে।

4 thoughts on “দ্বীপ রাষ্ট্র শ্রীলংকা ভ্রমণ”

  1. ভালো লাগলো। আপনার প্রতিটা পোষ্ট ই অসাধারণ…

    Reply

Leave a Reply