বাইকে করে ঢাকা থেকে কুয়াকাটা ভ্রমণ

ঢাকা থেকে কুয়াকাটা অনেক দূর। সরাসরি যাওয়ারও কোন পথ নেই। বাস সার্ভিস থাকলে তা দুইটা ফেরি পার হয়ে তারপর কুয়াকাটা পৌছে। যদিও ইনশাহ আল্লাহ সামনে সরাসরিই ঢাকা থেকে যাওয়া যাবে। পদ্মা সেতু হয়ে যাওয়ার পর। রাস্তাটাও অনেক সুন্দর করে তৈরি করা হচ্ছে।

এত দূর হওয়া সত্ত্বেও আমরা theBikerz গ্রুপ থেকে প্ল্যান করলাম বাইক ট্যুর দিব কুয়াকাটা। যেই প্ল্যান, সেই কাজ। ২৩ এ মার্চ শুক্রবার রাত ১২টার দিকে রওনা দেই আমরা। মিরপুরের কালশী থেকে। প্রায় বিশ জন। ১৭টা বাইক নিয়ে। সবাই সারিবদ্ধ হয়ে যাত্রা শুরু করা যেই দেখে, সেই তাকিয়ে থাকে। ঢাকা ইউনিভার্সিটির ভেতর দিয়ে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার হয়ে রওনা দেই মাওয়ার দিকে। মাওয়া যাওয়ার সাথে সাথেই আমরা একটা ফেরি পেয়ে যাই। উঠে পড়ি ফেরিতে। সব গুলো বাইক সারিবদ্ধ ভাবে রেখে অপেক্ষা করি অপর পাড়ে পৌঁছার। রাত হওয়ায় চার দিকে তেমন একটা কিছু দেখা যাচ্ছিল না। প্রায় দেড় ঘন্টা পর আমরা পৌছাই মাওয়ার অপর পাশে।

প্ল্যান করি কিছু খেয়ে নেওয়ার। মাওয়ার ইলিশ তো অনেকে এমনিতেও খেতে যায়। আমরা প্ল্যান করলাম ইলিশ দিয়ে খাওয়া দাওয়া করব। তখন প্রায় ভোর সাড়ে চারটা। একটা হোটেলে গিয়ে দেখি ওদের ভাত শেষ। অন্য হোটেলে ইলিশ শেষ। অন্য হোটেলের অন্য শাখা থেকে ইলিশ এনে আমাদের ভেজে দিল। খেতে খেতে অনেক সময় লেগে গেলো। চারদিকে ততক্ষণে আলোকিত হওয়া শুরু হয়েছে। আমরা রওনা দিলাম বরিশালের দিকে।

বরিশাল গিয়ে একটু রেস্ট নিয়ে আবার রওনা দেই কুয়াকাটার দিকে। রাস্তা মাঝে মধ্যে ভাঙ্গা থাকলেও বেশির ভাগ রাস্তা সুন্দর। অনেক ভালো লাগছিল বাইক চালাতে। বরিশাল থেকে পটুয়াখালি। এরপর কুয়াকাটা। পটুয়াখালি থেকে কুয়াকাটা যাওয়ার পথে আরেকটা ফেরি পার হতে হয় আমাদের। ছোট্ট দূরত্ত্ব। বেশি সময় লাগে না। কুয়াকাটা আমরা পৌঁছাই দুপুর একটার দিকে। যাওয়ার পথে আমরা বিভিন্ন চা দোকান বা কোন ফাঁকা রাস্তায় দাঁড়িয়ে রেস্ট নেই। গল্প করি, আবার রওনা দেই। এভাবেই এক সময় গন্তব্যে পৌঁছাই।

আমরা অনলাইনে একটা ভিলা বুকিং দিয়ে যাই। ঐটা পশ্চিম কুয়াকাটার দিকে। একটু ভেতরের দিকে। খুঁজে পেতে সময় লেগেছিল। ছোট ছোট ডুপ্লেক্স ঘর। প্রতিটাতে দুইটা করে রুম। খুবি সুন্দর। নাম হচ্ছে সিন্ডেরেলা রিসোর্ট।

এত দূর ড্রাইভ করার পর শরীরের অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। এছাড়া প্রচুর ঘুমও পাচ্ছিল। অন্য কোন দিকে না তাকিয়ে বিছানা পেয়েই শুয়ে পড়ি। প্রায় এক ঘন্টা পরে সবুজ ভাই ডেকে তোলে লাঞ্চ করতে যাওয়ার জন্য। কথা ছিল সুমিং পুলে গোসল করতে যাবে। ঘুম থেকে উঠে আমি ঠিক মত শুনতে পাই নি কই যাবে। আমি সুমিং পুলে যাওয়ার জন্য রেডি হই। পরে দেখি আসলে যাবে লাঞ্চ করতে।

এখানে সী গার্ল নামে একটা রেস্টুরেন্টে যাই আমরা। অর্ডার দেই। আমরা ৭ জন খেতে যাই। এক এক জন এক এক খাবার অর্ডার দেয়। আমি দিয়েছিলাম রুপচান্দা দো-পেয়াজো। সাথে ভর্তা। খাবার খুবি মজার ছিল। অর্ডার দেওয়ার সময় মেনু অনুযায়ী আমরা দাম দেখে জিজ্ঞেস করে নেই। এরপর যখন বিল করে, তখন বেশি করে বিল করে। এছাড়া দেরি করে যাওয়ার কারণে ডাল বা এমন সব খাবার ছিল না ঠিক মত। পরে যদিও বলার পর বিল ঠিক করে দেয়।

খাওয়া দাওয়া করে আমি আবার রুমে এসে আরেকটু ঘুমিয়ে নেই। ৫টার দিকে উঠে রওনা দেই বীচের দিকে। বাইক নিয়ে। এর আগে যখন কুয়াকাটা আসি, তখনও বাইকে করে বীচে ঘুরাঘুরি করি। যদিও অন্যের পেছনে। এবার নিজেই বাইক নিয়ে বীচে ঘুরতে থাকি। বীচে বাইক চালাতে কি দারুণ লাগছিল।

কুয়াকাটা বীচে আমাদের একাংশ

 

আরেকাংশ

 

কুয়াকাটা বীচে সূর্যাস্ত

সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা বীচে থাকি বাইক নিয়ে। এরপর কুয়াকাটা বীচের জিরো পয়েন্টের এদিকে আসি। এখানে মাছের বিভিন্ন বার-বি-কিউ পাওয়া যায়। আমরা চিংড়ি, টুনা এবং কাকড়ার বার-বি-কিউ করতে দেই। টুনা মাছ অনেকটা মাংশের মত। এগুলো খাওয়া দাওয়া করে রুমে ফিরি। বড় গ্রুপ ঘুরতে যাওয়ায় কুয়াকাটা গিয়ে ছোট ছোট গ্রুপ হয়ে নিজের মত করে সবাই ঘুরতে লাগল। কেউ বাসায় বসে বসে উনো খেলল। আমার কাছে ঘুমাতেই ভালো লাগছিল 😛

 

মজার ব্যপার হচ্ছে আমি তিন বছর আগে একবার কুয়াকাটা ঘুরতে যাই। তখন আর আজ একই দিন। ফেসবুক মনে করিয়ে দিয়েছিল। ঐ দিনও বীচে কাকড়া খেয়েছি। আজও একটু ট্রাই করলাম।

কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে রাতের খাবারের জন্য উঠি। আমাদের হোটেলে চিকেন বার-বি-কিউ এবং পরোটা তৈরি করেছিল আমাদের জন্য। হোটেলের চিকেন বার-বি-কিউ খুবি টেস্টি হয়েছিল। খাওয়া দাওয়া করে বীচের দিকে হাঁটতে যাই। রাতে সমুদ্রের পাড়ে হাঁটতে অসম্ভব ভালো লাগে। সমুদ্রের গর্জন শুনতে ভালো লাগে। ভালো লাগে নিজের প্রিয় কারো কথা ভাবতে। প্রিয় কিছু নিয়ে ভাবতে। মাঝে মাঝে মন ও খারাপ হয়ে পড়ে।

বার-বি-কিউ তৈরি

বীচে কিছুক্ষণ থেকে রওনা দেই হোটেলের দিকে। যাওয়ার পথে আইস্ক্রিম কিনে নেই।

রাতে প্ল্যান করেছি সকাল পাঁচটার দিকে উঠব। সূর্যদয় দেখব। আরো কত প্ল্যান। প্ল্যানের উপর ঘুমিয়ে পড়লাম। এলার্মও দিলাম। পরের দিন এলার্ম যখন ভাজতেছিল, তখন মনে হলো সব কিছু থেকে ঘুমটাই সুন্দর। আরো কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নেই। এরপর যা দেখা দেখা যাবে। এরপরের বার উঠেছি ৯টার দিকে। আহা। সব মিস করে ফেললাম। ঘুমানোর সময় মনে হয় ঘুমটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ঘুম থেকে উঠার পর মনে হয় আহা, কেন যে ঘুমালাম।

হোটেল থেকে নাস্তা দিল। পরোটা, ভাজি, ডিম আর চা। খাওয়া দাওয়া করে প্ল্যান ছিল বের হবো চার দিকে ঘুরতে। কিন্তু সূর্যের উত্তাপ দেখে মনে হলো এই রোদে বের হওয়া থেকে ঘুমানো বেটার। তাই আবার ঘুম!

১২টার দিকে উঠলাম। আমাকে নাইম ফোন দিয়েছিল। সে আসছে বরগুনা থেকে। প্রায় ৬০ কিলো দূরে কুয়াকাটা থেকে। বাইক নিয়ে চলে এসেছিল। ও আসার পর বের হলাম। এছাড়া পলাশ নামে একজনের সাথে গতকাল হুট করে দেখা হয়ে গেলো। উনার সাথে বনানী একই বাড়িতে ছিলাম। উনি বলল বের হলে কল দিতে। দেখা হলো। চা খাওয়ালো। চা খেয়ে গেলাম কুয়াকাটা জিরো পয়েন্টের দিকে। এরপর নাঈম লাঞ্চ করালো। লাঞ্চ করে বীচের দিকে গেলাম একটু।

কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত

এত রোদ। বেশিক্ষণ থাকতে পারলাম না। বীচ থেকে ফিরে এলাম। পাশেই ছিল মার্কেট। এর আগের বার যখন কুয়াকাটা এসেছি, তখন এত বড় মার্কেট ছিল না। এখন শুটকি মার্কেটটাও অনেক বড় করে তৈরি করা হয়েছে।   কুয়াকাটা থেকে আমাদের রওনা দেওয়ার কথা দুপুর একটার দিকে। আমি বের হওয়ার সময় ব্যাগ নিয়েই বের হয়েছি। বাকিদের সাথে এক সাথে এদিক থেকেই চলে যাবো চিন্তা করে। কিন্তু পরে দেখা গেলো উনাদের বের হতে হতে প্রায় ২টা বেজে গেলো। এরপর এসে খাওয়া দাওয়া করল। কুয়াকাটা থেকে বের হতে হতে ৪টা।

কুয়াকাটায় শুটকি মার্কেট

কুয়াকাটা থেকে রওনা দেওয়ার সময় সবাই মিলে ভাবল পায়রা বন্দর দেখে যাবে। আমরা রওনা দিলাম পায়রা বন্দরের দিকে। প্রায় ৩৫ কিলো দূরে। একটা ফেরি পড়ল পথে। ফেরি পার হয়ে কিছুদূর যাওয়ার পর কাঁচা রাস্তা শুরু। সামনে দিয়ে যারা গিয়েছে, তাদের বাইক বালু উড়াতে উড়াতে গেলো। পেছনের সবাই বালিতে সাদা হয়ে গেলো। দূর্ভাগ্য ক্রমে আমি পেছনে পড়ে বালিতে মাখামাখিয় হয়ে নিলাম।

পায়রা বন্দরে পৌঁছাতে পৌছাতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। ঐখানে পৌঁছানোর পর মাগরিবের আজান দেয়। বন্দর এখনো আন্ডার কনস্ট্রাকশন। ভেতরে যাওয়ার কোন অনুমতি আমরা পাইনি। এত দূর থেকে ড্রাইভ করে গেলাম দেখার জন্য। না দেখেই ফিরতে হলো। আমরা রওনা দিলাম ঢাকার দিকে।

বরিশাল পৌঁছেছি রাত সাড়ে এগারোটার দিকে। এরপর ঐখানে একটা রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খেয়ে নিলাম। ছোট্ট হোটেল হলেও খাবার গুলো যথেষ্ট ভালো ছিল। ইলিশ ভর্তা, টাকি ভর্তা, ছোট মাছ, ডাল ইত্যাদি দিয়ে খেয়ে নিলাম। মরিচের ভর্তা দিল একটা ফ্রি। ঐ ভর্তাটাও দারুণ ছিল। খাওয়া দাওয়া করে আবার রওনা দিলাম। মাওয়া যখন পৌঁছাই, তখন ফজরের আজান দেয়। ফেরি পার হয়ে এরপর ঢাকা এসে নিজ বাসা পৌছাতে পৌছাতে সকাল নয়টা হয়। শুকরিয়া যে আল্লাহর রহমতে সুস্থ ভাবে পৌঁছাতে পেরেছি।

ট্যুরের একটা ভিডিও করেছি। এখান থেকে দেখা যাবে

4 thoughts on “বাইকে করে ঢাকা থেকে কুয়াকাটা ভ্রমণ”

  1. এরকম ট্যুর সম্পর্কে আরও পোস্ট চাই। হোটেলের খরচ দেখার কোন লিংক হবে ?

    Reply
    • হোটেল খরচ খুব একটা বেশি না। ১০০০ টাকার নিছেই ভালো রুম পাওয়া যাবে।

    • হোটেল আর খাওয়া দাওয়া ১২০০ টাকার মত। তেল সম্ভবত ১০০০ টাকার মত।

Leave a Reply