নোমান আলি খানের সূরা আসর লেকচার

আমি পানিতে ডুবে যাচ্ছি। আমার কোন জ্ঞান নেই। যেহেতু জ্ঞান নেই, এর মানে আমার হাতে পর্যাপ্ত সময়ও নেই। এমন সময় আমাদের যেটা দরকার তা হচ্ছে জ্ঞান ফিরে পাওয়া। জ্ঞান ফিরে না আসলে বাঁচার সম্ভাবনা নেই। এমন সংজ্ঞাহীন অবস্থায় যদি সবচেয়ে সুন্দর স্বপ্নও দেখতে থাকি, তাহলেও কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য আমাকে জাগতে হবে।

হুশ আসার পর যখন দেখলাম অবস্থা খুব খারাপ, তখন কি হবে? তখন অবশ্যই সর্বোচ্চ চেষ্টা করব পানির উপরে উঠতে, তাই না? সাঁতার না পারলেও কিন্তু চেষ্টা করব হাত পা ছুঁড়ে উপরের দিকে উঠার। কোন ভাবে চেষ্টা করে উপরে উঠলাম। যখনি নিঃশ্বাস নিতে গেলাম, তখনি দেখলাম আমার পায়ের সাথে কিছু একটা বাঁধা। তার জন্য আবার ডুবে যাচ্ছি। খেয়াল করে দেখলাম পায়ের সাথে বাঁধা রয়েছে আমার ভাই। সেও দেখি অজ্ঞান! আমার তাও জ্ঞান ফিরেছে, তার জ্ঞান ফিরেনি এখনো। এখন তার জন্যই কিন্তু আবার আমি ডুবে যাচ্ছি।

তো আমার এই অবস্থায় কি করণীয়? তার জ্ঞান ফেরানো, তাই না? অনেক চেষ্টার পর তার জ্ঞান ফেরানো গেলো। আমরা দুইজনই কোন ভাবে ভেসে উঠলাম। এখন দেখলাম আবার ডুবে যাচ্ছি। দুইজনই। কারণ? আমাদের পায়ের সাথে দেখি অন্য কেউ বাঁধা রয়েছে। আমাদের মা-বাবা, অন্যান্য ভাই- বোন, আমাদের কাজিন, আমাদের অন্যান্য আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশি সহ আরো অনেকে। তো ততক্ষণে আমরা বুঝে গেলাম, একা বেঁচে থাকা যাবে না। সবাইকে নিয়েই বাঁচতে হবে। নিজের জ্ঞান ফিরলেই হবে না। সবার জ্ঞান ফিরাতে হবে। এক সাথে টিমওয়ার্ক করতে হবে। তা না হলে আস্তে আস্তে সবাইকে ডুবে যেতে হবে।

বুঝতে পারছেন তো আমরা কি নিয়ে কথা বলছি? আমরা বলছি সূরা আসর নিয়ে। হাতে পর্যাপ্ত সময় না থাকা, হাতের ফাঁক দিয়ে এমন সময় বের হয়ে যাওয়াকে আরবিতে বলা হয় আসর। সন্ধ্যার আগে দিন শেষ হয়ে যাওয়া অংশ হচ্ছে আসর। সূরা আসরের এই ছোট সূরায় আল্লাহ তায়লা বলেছেনঃ

১. শপথ অপরাহ্নের (সময়ের);

২. নিশ্চয় মানুষ ক্ষতির মধ্যে ডুবে আছে;

৩. কিন্তু তারা ব্যতীত, যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে উপদেশ দেয় সত্যের এবং উপদেশ প্রদান করে ধৈর্য্যের৷

অর্থ গুলো নিজেই বুঝার মত। ব্যাখ্যা করার দরকার পড়ে না আসলে। উপরের গল্পের সাথে মিলালে আমরা বুঝতে পারব আমরা সবাই ক্ষতির মধ্যে ডুবে আছি। কেউ কেউ তো অজ্ঞান অবস্থায় আছি। ক্ষতির মধ্যে যে আছি, তাও বুঝতে পারছি না। কিন্তু কারা ক্ষতির মধ্যে নেই? যারা বিশ্বাস স্থাপন করে। কিসের উপর? আল্লাহর উপর। এরপর তৃতীয় আয়াত পুরো পড়লে বুঝতে পারব যে শুধু বিশ্বাস করলেই হবে না। আমলও করতে হবে। একা একা আমল করলেও হবে না। অন্যদেরও আমল করার জন্য উপদেশ দিতে হবে। পুরো আয়াতটা কন্ডিশনাল। একটার উপর আরেকটা কন্ডিশন।

এখন দেখা যাবে আমরা কাউকে উপদেশ দিচ্ছি, সে শুনছে না। তখন কি করতে হবে? বারবার নিজের দ্বায়িত্বটুকু করে যেতে হবে। অজ্ঞান কাউকে জ্ঞান ফেরার জন্য আমরা কেমন চেষ্টা করতাম? কাউকে উপদেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে একই রকম চেষ্টা কি আমরা করছি? উপদেশ দেওয়ার সময় ধৈর্য ধরতে হবে। যদি ধৈর্য না ধরি, আমি নিজেও ঢুবে যাবো। তারাই ক্ষতির মধ্যে নেই, যারা বিশ্বাস স্থাপন, সৎকর্ম করা, উপদেশ দেওয়ার পাশাপাশী ধৈর্য্যও ধারণ করে।

ক্ষতি থেকে বাঁচতে হলে ক্রমান্বয়ে সব কিছুই করতে হবে। একটা করে আরেকটা না করলে হবে না। বর্তমান সময় কাউকে ঈমানের দিকে ডাকা অনেক কঠিন একটা কাজ। দেখেন, এই অংশটা না করতে পারলে আমরা ক্ষতি থেকে বাঁচতে পারব না। হয়তো কেউই আমাদের কথা আমলে নিবে না। এরপরও আমাদের আল্লাহর পথে ডাকতে হবে। আল্লাহ তায়লা আমাদের চেষ্টা টুকু দেখবেন। এরপর হয়তো আমাদের অক্ষমতা ক্ষমা করে দিতে পারেন। কিন্তু কতটুকু চেষ্টা করি আমরা? কতটুকু ধৈর্য্যশীল?

লেখাটি নোমান আলি খানের সূরা আসরের লেকচারের উপর নির্ভর করে লেখা। সংক্ষেপ করে লেখার চেষ্টা করছি।

লেকচারটির ভিডিও ইলাস্ট্রেশন বাংলায়ঃ

পুরো লেকচারের বাংলা ট্রান্সলেশনঃ

মনে করুন, আপনি পানিতে ডুবে যাচ্ছেন এবং ওই সময় আপনার কোন জ্ঞান নেই। অর্থাৎ অজ্ঞান অবস্থায় আপনি পানিতে তলিয়ে যাচ্ছেন। আপনার কি মনে হয়? এরকম একটা অবস্থায় আপনার হাতে কি বাঁচার জন্য অনেক সময় আছে? আপনি সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পানির গভীরে তলিয়ে যাচ্ছেন, এর মানে আপনার হাতে কিন্তু মোটেও সময় নেই! সময় খুব দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। আরবীতে এইভাবে সময় শেষ হয়ে আসাকে বুঝানোর জন্য ‘আসর’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। ‘আসর’ এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে সময়, যেটা শেষ হয়ে আসছে। দিনের শেষ সময়, যখন দিন শেষ হয়ে আসে, তখনই আসর নামাজ এর ওয়াক্ত হয়। ‘আসর’ শব্দের উংপত্তি হচ্ছে ‘অসির’ শব্দটি থেকে, যার মানে হচ্ছে চিপে রস বের করা, ‘সময়’ যেটা হাতের ফাঁক দিয়ে চলে যাচ্ছে। আমরা ভেজা কাপড় শুকাতে দেয়ার আগে দুইহাত দিয়ে মুচড়িয়ে যেভাবে পানি বের করি, আসর শব্দটি এধরনের অর্থ বোঝাতেই ব্যবহার করা হয়।

তারমানে এখানে আল্লাহ এমন একটা মুহুর্তের কথা বর্ণনা করছেন যখন আপনি সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পানিতে ডুবে যাচ্ছেন এবং আপনার সময় শেষ হয়ে আসছে। এমন অবস্থায় বেঁচে থাকতে হলে আপনাকে সর্বপ্রথম কোন কাজটা করতে হবে? বেঁচে থাকার আশা করতে হলে কোন জিনিসটা আপনার একেবারে শুরুতে দরকার? … কি মনে হয়? … জ্ঞান ফিরে আসা? … অবশ্যই! এটাই এখন আপনার সবার আগে দরকার! যদি জ্ঞান ফিরে না আসে তাহলে আপানার বাঁচার কোন সম্ভাবনাই নেই। এমনকি সংজ্ঞাহীন অবস্থায় আপনি যদি জীবনের সবচেয়ে সুন্দর স্বপ্ন ও দেখতে থাকেন, তবুও বাচতে হলে আপনাকে কিন্তু জাগতেই হবে। মনে করুন, স্বপ্নের মধ্যে আপনি দেখছেন সেইরকম সুন্দর, সাজানো গোছানো একটা জীবন আপনার। পাহাড়ের পাদদেশে আপনার চমৎকার বাড়ি। আপনি আপনার ফেরারী গাড়িটা নিয়ে লং ড্রাইভে বের হয়েছেন, রাস্তার একপাশে সবুজে ঢাকা পাহাড়, আর অন্য পাশে সুনীল সমুদ্র! কিন্তু যেই আপনার জ্ঞান ফিরে আসলো, আপনি বুঝতে পারলেন যে আপনি আসলে ডুবে যাচ্ছেন, পানির অতলে হারিয়ে যাচ্ছেন। এমতাবস্থায় জেগে উঠার পরে আপনার কিন্তু এমন মনে হবে না যে, ‘ইশ ! কি বাজে অবস্থা, পানিতে ডুবে যাচ্ছি। এর চেয়ে তো আবার ঘুমিয়ে পড়াই ভালো, কি সুন্দর স্বপ্ন দেখছিলাম’। শুধুমাত্র আপনি যদি মানসিকভাবে অসুস্থ বা পাগল হয়ে থাকেন, একমাত্র তখনই আপনার এইরকম মনে হতে পারে।

অথবা, কারো যদি বাস্তবতাকে মেনে নেয়ার মত সাহস না থাকে, সে এইরকম করতে পারে। কারণ,তাদের কাছে বাস্তবতা এতই কঠিন মনে হয় যে তারা জেগে উঠার পরও আবার ঘুমিয়ে যাওয়াকেই ভালো মনে করে। এই ধরনের লোক যারা ডুবে যাওয়ার সময় হুশ ফিরে আসার পরও পরিস্থিতি খারপ দেখে জোর করে ঘুমিয়ে থাকে, তারা কি তাদের খারাপ পরিণতির জন্য অন্য কাওকে দায়ী করতে পারবে? পারবে না, শুধুমাত্র নিজেই নিজেকে এর জন্য দায়ী করা ছাড়া আর কিছুই তারা করতে পারবে না।
যাইহোক, স্বাভাবিকভাবে ধরে নেই যে হুশ ফিরে আসার পরে সে যখন দেখল যে অবস্থা খুব খারাপ, সে ডুবে যাচ্ছে তখন সে আর ঘুমালো না; কিন্তু এর পরে সে কি করবে? এমন একটা অবস্থায় আপনি কি করতেন? … হাত, পা সবকিছু নাড়িয়ে চেষ্টা করতেন না পানির উপরে উঠতে? যদি সাঁতার নাও জানেন, তারপরও তো চেষ্টা করতেন। … কি? করতেন না? … আর এই চেস্টা করতে করতে যখন আপনি বুঝতে পারবেন যে এলোপাথাড়ি হাত-পা না ছুড়ে , একটা নির্দিষ্ট স্টাইলে হাত-পা নাড়ালে আপনি উপরের দিকে যাচ্ছেন, তখন আপনি ঠিক ঐভাবেই হাত পা নেড়ে উপরের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকবেন।

তারমানে, বাঁচার জন্য সর্বপ্রথম আপনাকে বেহুশ অবস্থা থেকে জেগে উঠতে হবে। এর পরে সাঁতার কেটে উপরের দিকে যেতে হবে। অথবা অন্য কোন উপয়ে হলেও উপরের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু যেই না আপনি পানির উপরে মাথা তুলে বড় করে নিঃশাস নিতে গেলেন, তখনি আপনি পায়ের গোড়ালি তে একটা চেইন এর উপস্থিতি টের পেলেন। সেই চেইন এর ওপর প্রান্তে কিছু একটা বাঁধা আছে যেটা আপানকে আবার পানির নিচে টেনে নিয়ে যেতে চাচ্ছে। ওপর প্রান্তের সেই জিনিসটা আর কিছুই না, সেটা আপনার ভাই, যে এখনো ঘুমিয়ে আছে পানির নিচে। তার মানে, আপনি ভেসে উঠার পরও আবার ডুবে যাচ্ছেন, কারণ আপনার ঘুমন্ত ভাই আপনার সাথে চেইন দিয়ে বাঁধা। তাহলে আপনি এখন কি করবেন? … অবশ্যই আপানাকে এখন আপনার সেই ভাইকে ঘুম থেকে উঠাতে হবে, তাই না? হয়তো আপনি আপনার সেই ভাইকে অনেক ভালবাসেন, অথবা বাসেন না। কিন্তু মূল বাপারটা হচ্ছে, এই মুহুর্তে আপনি আপনার সেই ভালোবাসা থেকে কিন্তু তাকে ডেকে তুলছেন না! আপনি নিজের গরজেই তাকে ডাকছেন। কারণ এই পরিস্থিতিতে আপনি যদি তাকে ডেকে না তুলেন তাহলে আপনি নিজে ও কিন্তু বাঁচবেন না।

তো, আপনি তাকে ডেকে তুললেন। জেগে উঠার পরে আপনার ভাই বলল, ‘আরে আমি কি সুন্দর ফেরারী গাড়ি নিয়ে লং ড্রাইভ এ যাওয়ার স্বপ্ন দেখছিলাম আর তুই খামোখাই আমাকে ডেকে তুললি? আমি আবার ঘুমাতে যাচ্ছি’। অর্থাৎ, সে আপনাকে বেমালুম উপেক্ষা করলো। তখন কি আপনি বলবেন যে, ‘ঠিক আছে, আমার কি আসে যায়। তোমার যা ভালো লাগে সেটাই কর’। … আপনি কিন্তু মোটেই এইরকম করবেন না। সে যদি আবার ঘুমিয়ে যায়, আপনি তাকে ধাক্কা দিতে দিতে বলবেন, ‘উঠ, আরে উঠ। তাড়াতাড়ি কর। আমাদেরকে বাঁচতে হলে পানির উপরে উঠতে হবে। এইভাবে থাকলে চলবে না’। এইভাবে যতক্ষন পর্যন্ত না সে ঘুম থেকে উঠে বলবে, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, বল কি করতে হবে?’; ততক্ষন পর্যন্ত আপনি চেষ্টা করবেন তাকে ঘুম থেকে তোলার। তারপর আপনারা দুইজনে এক সাথে সাঁতার কেটে পানির উপরে ভেসে উঠলেন। কিন্তু উঠার পরে বুঝতে পারলেন যে এইবার অন্য আরেকজন আপনাদের দুইজনকে আবার পানির নিচে টানছে। সেটা কে? সেটা হতে পারে আপনার বাবা, মা, দাদা, নানা, বোন, ছেলে, মেয়ে, কিংবা প্রতিবেশী। এর এইভাবেই সমস্ত প্রক্রিয়াটা বারবার চলতে থাকবে।

তারমানে বাঁচার জন্য একজন মানুষকে চারটি ধাপ পার করতে হবে:
১. সবার আগে তার নিজেকে ঘুম থেকে উঠতে হবে।
২. এরপরে সাঁতার কেটে উপরে যাওয়ার চেষ্টায় থাকতে হবে।
৩. এবং একই সময়ে তার পরিচিত অন্যদেরকেও (যাদের সাথে সে বন্ধনে জড়িত) ঘুম থেকে উঠাতে হবে। তাদেরকে বাস্তবতা বুঝতে হবে।
(৪ নম্বর ধাপটা নিচে বিস্তারিত ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে)
এইভাবে চলতে চলতে গ্রূপ এর একজন যদি বলে যে, ‘ভাই, আমি আর পারছি না। এইভাবে আর কত? আর কতবার এইরকম উপরে উঠে আবার আরেকজনের টানে নিচে আসতে হবে। আমি মনে হয় আর পারব না।’ তখন অন্য আরেকজন এগিয়ে এসে সাহস দিতে হবে, বলতে হবে – ‘না। আমরা ইনশাআল্লাহ একসাথেই এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাব। তোমাকে পারতেই হবে। আর অল্প কয়েকবার বাকি। চলো, চলো।’ আমরা মুভিতে অনেক সময়ই এধরনের অবস্থা দেখে থাকি। একদল লোক যখন কোন জায়গা থেকে পালাতে যেয়ে অনেক বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হয় এবং দলের দুর্বল সদস্য যখন বলে যে আমি আর পারছি না। তখন অন্যরা কিভাবে তাকে উৎসাহ দিয়ে সজীব রাখে। তারা সবাই একসাথে কাজ করে, একে অন্যকে আপ্রাণ সাহায্য করে, কারণ তাদের বেঁচে থাকাটাও একে অন্যের উপরে নির্ভরশীল।

যাইহোক, এখন আসুন আমরা দেখি আল্লাহ এই সুরায় ( আল আসর) কি বলেছেন:
প্রথমে তিনি বলেছেন, (ওয়াল আসর) সময় চলে যাচ্ছে, শেষ হয়ে যাচ্ছে।
তারপরে তিনি বলেছেন, (ইন্নাল ইনসানা লা.. ফি খুসর) মানুষ ক্ষতির মধ্যে ডুবে আছে।
শুধুমাত্র তারা ব্যতীত, যারা বিশ্বাস করে। … কি বিশ্বাস করে?
খেয়াল করুন, আল্লাহ কিন্তু এইখানে বলেন নাই যে, যারা ফেরেশতা, কিতাব, নবী রাসুল, মৃত্যু, কিয়ামত … ইত্যাদিতে বিশ্বাস করে। তিনি এইসব কিছুই বলেন নাই। এইসব অবশ্যই বিশ্বাস এর অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু এই সুরার বিষয়বস্তুর দিকে যদি আমরা তাকাই, তাহলে কি সেই বিষয়? যেটা এখানে মানুষকে সবার আগে বিশ্বাস করতে হবে? … সেটা হচ্ছে, তাদেরকে বিশ্বাস করতে হবে যে তারা ক্ষতির মধ্যে আছে! তারা ডুবে যাচ্ছে। আর তারা যদি এইটা বিশ্বাস করে নেয় এবং সেই অনুসারে নিজেদের ঈমানকে ঠিক করে নেয়, তাহলে তারা সাঁতার কেটে ক্ষতি থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করবে। আর এইটাকে আল্লাহ তা আলা কিভাবে বর্ণনা করেছেন? তিনি বলেছেন – ‘ওয়া আমিলুসসলিহাত’, তারা ভালো কাজ করে; তারা পরিস্থিতির উন্নতির জন্য কাজ করে। ‘সালিহাত’ হচ্ছে একটা বিশেষণ, যার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, ‘এমন জিনিস যা অন্য জিনিসকে ঠিক করে’।অর্থাৎ, ‘কিছু একটা ভুল ছিল এবং এইটা সেই ব্যাপারটাকে ঠিক করে’। তারমানে, তারা এমন কাজ করে যেটা প্রতিকুল পরিস্থিতিকে ঠিক করে। রূপক অর্থে আমরা যেটাকে সাঁতার কাটার সাথে তুলনা করছি।

কিন্তু, যেহেতু তারা অন্য মানুষদের সাথেও চেইন দিয়ে আটকানো, সেহেতু তাদেরকে শুধু নিজে সাঁতরালে হবে না, আরো কিছু করতে হবে। কি সেটা ? … ‘অতাওয়া সাওবিল হাক্ক’ – অর্থাৎ, তাদেরকে বাকি সবার কাছে (যারা ঘুমিয়ে আছে) এই সত্যটা বলতে হবে। শুধু বললে হবে না, বারবার বলতে হবে। যতক্ষণ না তাদের ঘুম পরোপুরি ভেঙ্গে যায়। কারণ, আপনি যাদের বাচাতে চেষ্টা করছেন, তাদের একবার, দুইবার এইসব বললে তাদের ঘুম না ও ভাঙ্গতে পারে। এমন ও হতে পারে কিছুক্ষণ জেগে থেকে তারা আবার ঘুমিয়ে পড়ছে। আপনি আবার তাদের উঠালেন, একটু পরে তারা আবার ঘুমিয়ে পড়লো। এইভাবে চলতে চলতে দেখা গেল আপনি ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলছেন। আর এই কারণেই আল্লাহ আরও বলেছেন – ‘ওয়াতাওয়াসাও বিসসবর ‘ – আপনাকে এইকাজটা ‘সবর’ সহকারে করে যেতে হবে। সবর অর্থ: নিয়মনুবর্তিতা, ধৈর্য্য, অধ্যবসায়, দৃঢ়তা ইত্যাদি। অর্থাৎ আপনাকে লক্ষ্যে অটুট থেকে কাজ করে যেতে হবে। কারণ, আপনার বাঁচা – মরা এর সাথে জড়িত। আপনি এতকিছু করার পরে যদি একটুর জন্য ধৈর্য্যহারা হয়ে যান, তাহলে তো আপনি নিজেও ডুবে যাবেন। যেমন, ধরুন আপনার ইমান আছে (১), আপনি ভালো কাজ ও করেন (২) এবং আপনি মানুষকে ও সত্যের পথে ডাকছেন (৩); কিন্তু আপনার সবর (৪) নেই। তারমানে, এতকিছুর পর ও আপনি ঠিকই ডুবে যাবেন।
অর্থাৎ, ক্ষতির হাত থেকে বেঁচে থাকতে হলে আপনাকে চারটি শর্তের সবগুলোই পূরণ করতে হবে। প্রতিটি শর্তই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং একটির সাথে অন্যটি ক্রমানুসারে সংযুক্ত। যেটা এই সূরাতে অতন্ত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

1 thought on “নোমান আলি খানের সূরা আসর লেকচার”

Leave a Reply