শিক্ষা সফর

ইউনিভার্সিটি জীবনের প্রথম শিক্ষা সফর। অনেক এক্সাইটেড আমরা। কে কোথায় বসবে, কার পাশে বসবে এসব নিয়ে অনেক পরিকল্পনা। পেছনে বসলে বেশি দুষ্টুমি করা যাবে চিন্তা করে আমরা পেছনেই বসলাম। কিছুক্ষণ পর যদিও বুঝেছি আমাদের সিট না হলেও হত।

বাস ছেড়ে দেওয়ার পর সুপারভাইজারকে বলল গান ছাড়তে। ঐ বেটা মনে হয় রেডিই ছিল। বলার সাথে সাথে গান ছাড়ল। শিমুল বলল এসব গানে হবে না। পেনড্রাইভে গান লোড করে নিয়ে এসেছে সে। নতুন হিন্দি কালেকশন। ফুল ভলিউম দিয়ে সেগুলো ছাড়ল। মনে হচ্ছিল যেন আনন্দের মাত্রা একটু বেড়ে গেলো।

সবাই এবার গানের তালে তালে নাচ শুরু। দুই পাশের অন্য বাস এবং গাড়ি থেকে তাদের আনন্দ দেখছিল সবাই। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই গাজীপুর আমাদের জন্য ঠিক করা রিসোর্টে পৌঁছে গেলাম। রিসোর্টে পৌঁছে কেউ হাঁটাহাঁটি করছিল, কেউ ক্রিকেট খেলছিল, কেউ ফুটবল, কেউ ছবি তুলছিল, আর কেউ কেউ এসেছে সম্ভবত প্রেম করার জন্য।

খেলাধুলা শেষে অনেকেই সুইমিং পুলে গিয়ে নামল। সুইমিং পুল জিনিসটা আমার খুব একটা ভালো লাগে না। কারণ কেউ যদি হিসু করে দেয়, তাহলে তো বুঝার উপায় নেই। এই গুলো গায়ে লাগবে। ইয়াক! তার উপর এক জনের শরীরে এক ধরনের জীবাণু থাকে। সুইমিং পুলের মাধ্যমে সবার গায়ে ছড়ানোর ভয় থাকে। তার থেকে বরং রিসোর্টটা ঘুরে দেখা যাক।

হাঁটতে হাঁটতে জুরাইনের সাথে দেখা। ঘাসের উপর একটা গাছের ছায়ায় বসে আছে। জিজ্ঞেস করলাম কিরে, সবাই সুইমিং পুলে কত মজা করছে, তুই এখানে? বলল রেস্ট নিচ্ছি। ফুটবল খেলে টায়ার্ড। তাছাড়া…

তাছাড়া বলে থামল জুরাইন। আমি বললাম তাছাড়া কি? কিছুটা ইতস্তত করল। বলল পানিতে নেমে গোসল করতে আমার খুব ভালো লাগত কিন্তু সেখানে ছেলে মেয়েরা যেভাবে এক সাথে গোসল করে, সেখানে নিজের নফসকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়বে। বার বার জিনার মত গুনাহ হবে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম কিভাবে। সে বলল যে সব মেয়েদের সাথে আমাদের বিনা দরকারে দেখা করা জায়েজ নেই, তাদের দিকে কুনজরে তাকানো জিনার সমান গুনাহ। দেখো না, ঐখানে গেলে শয়তান আমাদের কত ভাবেই না ফুসলাবে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়বে। ইচ্ছে না থাকা সত্বেও বার বার চোখ চলে যাবে। যেখানে গেলে এত বড় গুনাহ হচ্ছে, সেখানে যাই কিভাবে বল?

মনে একটু ভাবনার উদয় হলো। কিছুক্ষণ আগে করা নিজের গুনাহ গুলোর কথা মনে পড়ে গেলো। এসব নিয়ে যে আমি একেবারে জানি না, তা নয়। কিন্তু আসলে ঐ ভাবে উপলব্ধি করি না। কত সহজেই স্রোতে গাঁ বাসিয়ে দিয়েছি। সবাই যা করে বেড়ায়, তাই করে বেড়াই। কোনটা গ্রহণ করা উচিত, কোনটা বর্জন করা উচিত, এসব নিয়ে ভাবি না। অথচ আসার সময়ও তো বাসে গানের তালে সবার সাথে নেচেছি। যেখানে ছেলে মেয়ে সবাই ছিল। সুইমিং পুলের পাশেও তো অনেকক্ষণ বসে ছিলাম। কই, কখনো তো অপরাধবোধ কাজ করেনি।

কিছুক্ষণ বসে থাকার পর আজানের শব্দ শুনা গেলো। জুইরাইন বলল নামাজ পড়তে হবে। ও উঠে নামাজের ঘরের দিকে গেলো। আমি পেছনে পেছনে গেলাম। আমাকে বলেও নি যে, চল নামাজ পড়ে আসি। মনে পড়ে গেলো ফেসবুকে দেখা একটা লেখার কথা। নিজে ইসলাম মানাই হচ্ছে ইসলামের সবচেয়ে বড় দাওয়াহ।

নামাজ পড়ে এসে দেখলাম সবাই খাবারের জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছে। ব্যুফে সিস্টেম। একটা প্লেট নিয়ে পছন্দ মত খাবার নিয়ে বসলাম। আমাকে দেখে সামিয়া আমার পাশে এসে বসল। সামিয়া কিছু জিজ্ঞেস করলে হু হ্যাঁ বলে উত্তর দিচ্ছিলাম। বার বার সামিয়ার দিকে তাকাতে ইচ্ছে করছিল। পাশাপাশী জিনার মত কবিরা গুনাহর কথা মনে পড়ল। নিজের ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ করা কি যে কঠিন, বুঝতে পারলাম। এরপরও চেষ্টা চালিয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ পর সামিয়া উঠে চলে গেলো। আমার প্লেটের খাবার গুলো শেষ হলে আমিও নতুন করে খাবার নিতে গেলাম। কিন্তু এবার আর সামিয়া পাশে এসে বসেনি। মেয়েটার মনে কষ্ট দিয়েছি চিন্তা করে খারাপ লাগল। তাকে কষ্ট না দিলে আল্লাহ তায়লাকে কষ্ট দেওয়া হত। আখেরাতে জবাবদিহি করতে হত। আর তা দুইজনের জন্যই খারাপ হত।

খাওয়া দাওয়া শেষে আবারও সবাই যে যার মত করে হাঁটাহাঁটি করছিল। এরপর অডিটোরিয়ামে সবাই জড়ো হচ্ছিল। সাংকৃতিক অনুষ্ঠান হবে। শুরু হয়েছে কোরআন তেলাওয়াত দিয়ে। এরপর গেম গুলোতে যারা জিতেছে তাদের পুরষ্কার দেওয়া হয়েছে। একটা ছোট নাটিকা উপস্থাপন করা হয়েছে। কিছু কৌতুক পরিবেশন করা হয়েছে। এরপর গান। প্রথম দিকে সফট কিছু গান গেয়েছে। এরপর যখন স্যারেরা চলে গেলো, তখন রক গান গাওয়া শুরু করল। সবাই নিজ আসন ছেড়ে মিউজকের তালে তালে নাচা শুরু। অন্তরের কোথাও যেন কেউ একজন বলছিল এখান থেকে উঠে যেতে। মিউজিক ছেড়ে উঠতে ইচ্ছেও করছিল না। উল্টো সবার সাথে নাচতে ইচ্ছে করছিল। এরপরও উঠলাম। উঠে বের হলাম। সূর্য এখনো ডুবেনি। সন্ধ্যার পর বাস ছাড়বে। ভাবলাম একটু হেঁটে আসা যায়। সুন্দর একটা পুকুর দেখেছি, পুকুরের দিকে রওনা দিলাম।

পুকুরে অনেক মাছ। কিছুক্ষণ আগে ওদের জন্য খাবার ছিটানো হয়েছে, সেই খাবার গুলো খাচ্ছে। দৃশ্যটা সুন্দর। প্যাডেলিং বোট রয়েছে কিছু। দুপুরে যেগুলোতে উঠার জন্য সবার লাইন ছিল, এখন সব গুলোই খালি। একটাতে উঠে প্যাডেলিং করে পুকুরে কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করলাম। আজান দিলে মাগরিবের নামাজ পড়ে নিলাম। সবার জন্য স্ন্যাক্স এবং চা/কফি দিয়েছে। খেয়ে বাসে গিয়ে উঠলাম সবাই।

অভ্যাস বসত বাসের পেছনের দিকেই গিয়ে বসলাম। বাস ছাড়ার পর আবার গান। আবার সবার নাচানাচি। সামনের দিকে চলে গেলাম। দেখলাম জুরাইন বসে আছে। তার পাশে গিয়ে বসলাম। ও মোবাইলে কি যেন পড়ছে। কৌতূহল মিটাতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম কি করছ। ও দেখালো। একটা হাদিসের অ্যাপ। শেয়ারইট দিয়ে আমার মোবাইলে নিয়ে ইন্সটল করে নিলাম। টুকটাক ওর সাথে গল্প করলাম। ইসলামিক কিছুই না। এরপরও ওর থেকে ইসলামের অনেক কিছু জানা হলো। জানা বলতে উপলব্ধি করা। যে সব কিছু জেনেও মানা হয়ে উঠত না। শিক্ষা সফরে সাধারণত কিছু শেখা না গেলেও এই সফর থেকে কিছু শিক্ষা নিয়েই ফিরলাম। যা এই পৃথিবীর পাশা পাশী আখেরাতেও কাজে দিবে।

1 thought on “শিক্ষা সফর”

Leave a Reply