ভরা পূর্ণিমায় টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণ অভিজ্ঞতা

স্বচ্চ পানি উপভোগ করার জন্য টাঙ্গুয়ার হাওর দারুণ একটা জায়গা। এক সাথে এখানে অনেক ধরণের অভিজ্ঞতা অর্জন করা যায়। আমরা গিয়েছি পূর্ণিমাতে। পূর্ণিমার আলোতে পুরো হাওর অন্যরকম সুন্দর একটা রূপ ধারণ করে। দূরে মেঘালয় এর পাহাড় দেখা যায়। পাহাড়ের পাদদেশে এই হাওর। আমরা গিয়ে ৩৬ জনের মত। স্বপ্নযাত্রার আয়োজনে।

রওনা দিয়েছি ৫ তারিখ রাতে, ফকিরাপুল থেকে পুরো একটা বাস রিজার্ভ করে। পুরো বাস যখন আমাদের, তখন ইচ্ছে মত মজা করা যায়। বাঁধা দেওয়ার কেউ থাকে না। গন্তব্য আমাদের সুনামগঞ্জ। সুনামগঞ্জ পোছাই সকালের দিকে। একটা ব্রিজের কাছে নামিয়ে দেয়। সম্ভব সুরমা ব্রিজ বলে ঐটাকে। সেখান থেকে লেগুনায় করে আমরা রওনা দেই তাহিরপুর। মোটামুটি দেড় ঘন্টার মত লাগে আসতে। তাহেরপুর বাজারে নেমে নাস্তা করে নেই সবাই। নাস্তা করা পর চলে যাই ঘাটে। বাজারের কাছেই ঘাট। বলা যায় টাঙ্গুয়ার হাওরের বেজ স্টেশন। হাওরে যাওয়ার জন্য সব ট্রলার এখানে নোঙ্গর করে রাখা। সব পর্যটক নিজ নিজ ট্রলারে উঠে অপেক্ষা করতে লাগল।

যাদুকাটা নদী ও দূরে মেঘালয়ের পাহাড়

 

১১টার দিকে আমরা রওনা দিয়েছি যাদুকাটা নদীর দিকে। প্রায় দুই ঘন্টার মত ট্রলারে ছিলাম আমরা। দুই পাশের সৌন্দর্য্য দেখতে দেখতে যাওয়া। যাদুকাটা নদীর একটা তীরে আমরা নেমে গোসল করে নেই। পানি গুলো এত স্বচ্ছ, এত সুন্দর। একপাশে নদী, আরেক পাশে পাহাড়। সুন্দর যায়গা। গোসল করে রওনা দেই বারিক্কাটিলার দিকে।

টিলায় উঠার আগে ট্রলারের মধ্যে আমরা দুপুরের খাবার খেয়ে নেই। এরপর আস্তে ধীরে বারিক্কাটিলার দিকে রওনা দেই। বেশি উপরে নয়। ১০ মিনিট হাটলেই টিলার উপরে পৌছানো যায়। টিলার উপর থেকে নদী এবং পাহাড় অন্যরকম সুন্দর দেখায়।

বারিক্কাটিলার উপর থেকে পাহাড় ও যাদুকাটা নদী

টিলা থেকে নেমে আমরা রওনা দেই একটা শিমুল তুলার বাগানে। সারি সারি অনেক শিমুল গাছ। যে কোন দিক থেকেই গাছের সমতা দেখা যাবে।

শিমুল তুলার বাগান

এরপর রওনা দেই ট্যাকের ঘাটের দিকে। ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। সূর্য ডুবি ডুবি করছে। পশ্চিম দিক লাল আকার ধারণ করেছে। যদিও সূর্য ডোবার সময় সব সময়ই হয়, কিন্তু শহরে দালান কোটার জন্য আমরা ঠিক মত দেখতে পাই না। হাওরে অনেক এলাকা জুড়ে খালি থাকায় দারুণ লাগে।

আগের রাতে ঠিক মত না ঘুমানোর কারণে ঘুম পাচ্ছিল। ট্যাকের ঘাটের দিকে যেতে যেতে আমি ট্রলারের উপর কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিলাম। ঘুম থেকে জেগে দেখি আকাশে বিশাল একটা চাঁদ উঠছে। অনেকটা সকালে সূর্য উঠার মত করে। দূর থেকে পাহাড় দেখা যায়। পাহাড়ে দেখা যায় ইন্ডিয়ান বর্ডার, সার্চ লাইট জ্বেলে রেখেছে। টেকের ঘাটে ট্রলার বেড়ালো। আমরা ঘাটে নামলাম। এখানে লোকাল একটা বাজার রয়েছে। বাজারে গিয়ে চা নাস্তা খেয়ে নিলাম। এদিক সেদিক হাটাহাটি করলাম। এখানে একটা স্মৃতিসোধ রয়েছে। ঐখানে বসার সুন্দর জায়গা রয়েছে। চাঁদের আলোতে সবাই মিলে বসে আড্ডা দিলাম। আমরা ছাড়াও এখানে অনান্য অনেক পর্যটক রয়েছে। পূর্ণিমায় টাঙ্গুয়ার সৌন্দর্য্য দেখতে সবাই ছুটে এসেছে।

সাড়ে এগারোটার দিকে আমরা ট্রলারে ফিরলাম। সবাই মিলে ট্রলারে বসে রাতের খাবার খেয়ে নিলাম। চাঁদের আলোয় চারদিক অসম্ভব সুন্দর দেখাচ্ছে। যে যার মত করে আড্ডা দিচ্ছিলাম। এরপর আস্তে আস্তে দেখলাম আকাশ কালো হতে লাগল। চাঁদটা মেঘে ঢেকে গেলো। মাঝিরা ট্রলার গুলো নোঙ্গর ফেলে ভালো করে বেঁধে নিল। ঝড় হওয়ার আশঙ্কা করছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি শুরু হলো। আমরা ট্রলারে ছাদ থেকে ট্রলারের ভেতরে চলে গেলাম। যে যার মত করে জায়গা খুঁজে ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকালে সূর্যদয়ের আগে জেগে উঠি। উঠে দেখি ঘাট থেকে ট্রলার একটু দূরে, হাওরের দিকে। রাতে ট্রলার ঘাটে না রেখে ঘাট থেকে একটু দূরে রাখা হয়। মাঝিরা তখনো ঘুমাচ্ছে। আমরা নিজেরা নিজেরাই ঘাটের দিকে ট্রলার নেওয়ার চেষ্টা করলাম। এরপর নেমে গেলাম চারপাশ দেখতে।

লাকমাচড়া নামে একটা জায়গা রয়েছ এখানে। টেকের ঘাট থেকে ১৫ মিনিটের হাঁটার দূরত্ব। মোটর সাইকেলেও যাওয়া যায়। মোটরসাইকেল ঘাটেই থাকবে আপনার জন্য। মোটরসাইকেলে রওনা দিলাম সেখানে। যাওয়ার পথে অনেক গুলো চড়া পড়বে। চড়া বলতে পাহাড় থেকে পানি হাওরে যাওয়ার নলা। লাকমাচড়া একটু বড় চড়া। এখানে অনেক মানুষকে পাথর তুলতে দেখলাম।

লাকমাচড়া

লাকমাচড়া থেকে আবার ঘাটে ফিরলাম। এরপর গেলাম নীলার্দি লেকে। ঘাটের পাশেই। ৫ মিনিট হাঁটা দূরত্ব। নীলার্দি লেকের পানি গুলোও অনেক স্বচ্ছ। এছাড়া লেকের চারপাশ অনেক সুন্দর। যেন ঘাসের বিছানা। নীলার্দি লেকের পরেই ইন্ডিয়ান বর্ডার। ঐখানে BSF কে দেখলাম পাহারা দিতে। আমরা ঐখানে ছবি তোলার সময় এক BSF বলল, এখানে ছবি তোলে না বন্ধু!

নীলার্দি লেক

 

নীলার্দি লেকের পাশে ছোট্ট একটা টিলা
হাওরে এক ঝাক হাঁস

 

নীলার্দি থেকে আবার ট্রলারে ফিরলাম। সূর্য নিজ তেজ দেখাচ্ছে। সবাই যে যার মত করে ঘুরতে লাগল চারপাশ। মাঝিরা ঘুম থেকে উঠে আমাদের জন্য রান্না করল। আমরা খাওয়া দাওয়া করে নিলাম। এরপর রওনা দিলাম টাঙ্গুয়ার হাওরের ওয়াচ টাওয়ারের দিকে। ওয়াচ টাওয়ারের সাথে ট্রলার রাখল। আমরা নেমে গেলাম হাওরে। এত সুন্দর, স্বচ্ছ পানি। যে কারো পানিতে নামতে ইচ্ছে করবে। হাওরের মাঝে যেতে যেতে দেখলাম ঘর বাড়ি। স্কুলও। স্কুলের পাশে দেখলাম অনেক গুলো ছোট ছোট নৌকা। বর্ষায় এখানের মানুষের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়ার একমাত্র বাহন।

টাঙ্গুয়ার হাওর
হাওরের মাঝে মাঝে রয়েছে ঘর বাড়ি। স্কুলও।
একটি পানকৌড়ি

পানিতে নেমে আর উঠতে ইচ্ছে করে না। মামুন ভাই (আমাদের হোস্ট) ট্রলার থেকে ডাকা শুরু করল। দুপুরের খাবার খেতে হবে। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও ট্রলারে ফিরলাম। এরপর সবাই মিলে রওনা দিলাম পাশের একটা গাছের ছায়ায়। গাছের ছায়ায় ট্রলারের উপর আমরা দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। এরপর আস্তে ধীরে রওনা দিলাম বেজ স্টেশনে। সুন্দর এই হাওর রেখে ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও নিজ নিজ নীড়ে তো ফিরতে হবে। সন্ধ্যার মধ্যেই তাহিরপুর বাজারে পৌছে গেলাম। সেখান থেকে লেগুনায় করে রওনা দিলাম সুনামগঞ্জ। সুনামগঞ্জ শহরে রাতের খাবার খেয়ে রওনা দিলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে। শেষ হলো আরেকটি সুন্দর ভ্রমণ।

4 thoughts on “ভরা পূর্ণিমায় টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণ অভিজ্ঞতা”

  1. এত সুন্দর করে লিখেছেন পড়তে পড়তে আমিও কল্পনায় ভ্রমণ করে ফেললাম… হা হা হা

    Reply
  2. এখন যায়তে ইচ্ছা করছে জাকির ভাই। যে সুন্দর ছবি আর লেখার টোন। নেক্সট কোন একদিন চলে যাবো নিশ্চিত। <3

    Reply

Leave a Reply