আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে ধারণা এবং আমাদের অবস্থান

আমরা প্রযুক্তির এমন একটা পর্যায় এসে পৌঁছেছি যে যা একই সাথে আশীর্বাদ হতে পারে অথবা হতে পারে বিধ্বংসী। খুব দ্রুত প্রযুক্তি জগতে পরিবর্তন আসছে। এতই দ্রুত সব কিছু পরিবর্তন হচ্ছে যে সবচেয়ে আধুনিক প্রযুক্তিও অল্প কয়েকদিনের মধ্যে সেকেলে হয়ে যাচ্ছে।

কম্পিউটার বা যে কোন মেশিন হচ্ছে বোকা বাক্স। এগুলোকে কাজে লাগানোর জন্য ইন্ট্রাকশনের দরকার হয়। প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করে আমরা কম্পিউটার বা যে কোন মেশিনকে কিছু ইন্সট্রাকশন দেই। কম্পিউটার বা মেশিন গুলো সে অনুযায়ী কাজ করে।

এই মেশিনকে আমরা যে ইন্সট্রাকশনই দিব, মেশিন সে অনুযায়ীই কাজ করবে। এর বাহিরে নিজ থেকে কিছু করতে পারবে না। মেশিন যেন নিজ থেকে কিছু করতে হলে তার কিছু বুদ্ধি শুদ্ধি লাগবে। মেশিনের বুদ্ধি শুদ্ধিকে আমরা বলি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। একটা রোবটের কথা যদি চিন্তা করি, রোবটের বুদ্ধি হচ্ছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স।

বুদ্ধি জিনিসটা কি?

বুদ্ধি হচ্ছে জ্ঞান আহরণ করা এবং তা প্রয়োগ করার ক্ষমতা। সাধারণ প্রোগ্রাম গুলো জ্ঞান আহরণ করতে পারে না। কিন্তু যেসব মেশিন বা প্রোগ্রামকে এমন ভাবে তৈরি করা হয়, যেন নিজে নিজে কিছু শিখে নিতে পারে, সেগুলোকে আমরা বলি বুদ্ধিমান প্রোগ্রাম বা বুদ্ধিমান মেশিন। যেমন গুগল সার্চ প্রোগ্রামটা একটা বুদ্ধিমান প্রোগ্রাম। আমরা কিছু সার্চ করলে এটি আমাদের আগের সার্চ হিস্টোরি, বয়স, লোকেশন ইত্যাদির উপর নির্ভর করে আমাদের সার্চ রেজাল্ট দেখায়। এছাড়া বর্তমানের চ্যাট জিপিটি হচ্ছে একটা বুদ্ধিমান প্রোগ্রাম। মিডজার্নি এআই হচ্ছে একটা বুদ্ধিমান প্রোগ্রাম। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর লক্ষ্য হচ্ছে কম্পিউটার বা মেশিনকে মানুষের মত জ্ঞান দান করা। মানুষের মত চিন্তা করার ক্ষমতা দান করা।

আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা 

কোন মেশিন বা প্রোগ্রামের নিজে নিজে কোন সীদ্ধান্ত নিতে পারাটাই হচ্ছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। কোন মেশিন বা প্রোগ্রাম শুধুমাত্র যদি তাকে দেওয়া ইন্সট্রাকশন অনুযায়ী কাজ করে, তাকে আমরা বুদ্ধিমান প্রোগ্রাম বলতে পারি না। তা যত বড় বা যত কমপ্লেক্স প্রোগ্রামই হোক না কেন। যেমন বর্তমানে কল কারখানায় অনেক ধরণের রোবট বা মেশিন ব্যবহার হয়। সেই রোবট বা মেশিন সেট করা নির্দিষ্ট কাজ গুলোই করতে পারে। এই মেশিন গুলো বুদ্ধিমান মেশিন নয়। আবার ঘরের ময়লা পরিষ্কার করার জন্য অনেক ধরনের ভ্যাকুয়াম ক্লিনার পাওয়া যায়। সেগুলো আবার ফ্লোরে ময়লা আছে কি নেই, সেই অনুযায়ী সীদ্ধান্ত নিতে পারে। তাই এই ভ্যাকুয়াম ক্লিনার গুলোকে আমরা বুদ্ধিমান মেশিন বলতে পারি।

আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্সের সূচনা

আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স বা কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার জনক হচ্ছেন জন ম্যাকার্থি। ১৯৫৬ সালে ডার্থমাউথ কনফারেন্সে জন ম্যাকার্থি দশ জন কম্পিউটার বিজ্ঞানীর সামনে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা কি, কিভাবে একটা মেশিন মানুষের মত শিখতে পারবে এবং যুক্তি দেখাতে পারবে, তার ব্যাখ্যা দেন। ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্সের উপর অনেক রিচার্স হয়। ঐ সময় এই ফিল্ডে থিওরিটিক্যালি অনেক অগ্রসল হলেও ব্যবহারিক দিক দিয়ে খুব একটা অগ্রসর হতে পারেনি। এখন যদি আমরা পেছনে তাকা, তাহলে কারণটা সহজেই বের করতে পারি। তখন যে কম্পিউটার ছিল তা থেকে বর্তমানে পাওয়া সাইন্টিফিক ক্যালকুলেটর গুলো আরো বেশি কাজ করতে পারে। ১৯৫৬ সালের দিকে ইন্টারনেটই ছিল না। তথ্য গুলো সব বইতে সংরক্ষণ ছিল। এটাও একটা কারণ ঐ সময় কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশ না হওয়ার।

১৯৭৪ সালের পর থেকে এই ফিল্ডে অনেক বছর রিসার্চ বন্ধ ছিল। ১৯৯৪ সাল থেকে আবার আস্তে আস্তে এই ফিল্ডে রিচার্স বাড়তে লাগল। পাশা পাশি কম্পিউটারের সক্ষমতাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এই ফিল্ডে খুব দ্রুত ইফেক্টিভ রেজাল্ট দেখা শুরু করল যখন GPU সহজ লভ্য হলো। সাধারণত কম্পিউটার গুলোর মধ্যে থাকে মূলত CPU বা সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিট। যা একবার একটা করে তথ্য প্রসেস করতে পারে। GPU বা গ্রাফিক্স প্রসেসিং ইউনিট একটু অন্য ভাবে কাজ করে। GPU এক সাথে সমান্তরালে অনেক গুলো তথ্য প্রসেস করতে পারে।

একটা মেশিন তখনি মানুষের মত বুদ্ধি খাঁটিয়ে কোন কিছু বলতে পারবে বা করতে পারবে যখন মানুষের মত অনেক কিছু জানবে। একটা ছোট শিশু কিন্তু শুরুতে কিছুই জানে না। বড় হতে হতে অনেক কিছু শিখে। এরপর এক সময় বুদ্ধি খাঁটিয়ে পারিপার্শিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে কোন কাজ করতে পারে। কম্পিউটারও তেমন। তার কাছে যদি পর্যাপ্ত তথ্য না থাকে, তাহলে সে শিখবে কিভাবে? আর না শিখতে পারলে তো কোন উত্তরও দিতে পারবে না। তো বর্তমান সময় ইন্টারনেটে প্রচুর তথ্য রয়েছে। GPU এর পাশা পাশি এই তথ্য গুলোকে কাজে লাগিয়ে বর্তমানে অনেক গুলো বুদ্ধিমান প্রোগ্রাম তৈরি করা হয়েছে।

বিভিন্ন এক্সপার্ট এর মতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার তিনটা ক্যাটেগরি রয়েছে।

ANI বা Artificial Narrow Intelligence: ANI হচ্ছে একটা নির্দিষ্ট এরিয়াতে এক্সপার্ট। যেমন যে মেশিন দাবা খেলতে পারবে, সে শুধু দাবাই ভালো পারবে। দাবা খেলা থেকে লুডু খেলা সহজ হওয়া সত্ত্বেও তাকে দাবা খেলার পরিবর্তে যদি লুডু খেলতে দেয়, সে পারবে না। ANI কে Weak AI ও বলা হয়। একে আমরা বলতে পারি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রথম ধাপ।

AGI বা Artificial General Intelligence: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্বিতীয় ধাপ হচ্ছে AGI। এটাকে Strong AI, বা Human-Level AI ও বলা হয়। এ ধাপে কম্পিউটার মানুষের মত চিন্তা করতে পারবে, মানুষের মত প্ল্যান করা, সমস্যা সমাধান করা, হঠাৎ নতুন কোন পরিবেশে আসলে চারপাশ দেখে সে পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেওয়ার মত ক্ষমতা অর্জন করবে। চ্যাট জিপিটি, মিডজার্নি এসব হচ্ছে আর্টিফিশিয়াল জেনারেল ইন্টিলিজেন্সের প্রথম ধাপ। এগুলো হয়তো শীগ্রই পুরোপুরি মানুষের মত চিন্তা করতে পারবে।

ASI বা Artificial Super Intelligence: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার তৃতীয় ধাপ। কম্পিউটার যখন মানুষ থেকেও বুদ্ধিমান হবে তখন তাকে আমরা বলব আর্টিফিশিয়াল সুপার ইন্টেলিজেন্স। আর্টিফিশিয়াল সুপার ইন্টেলিজেন্স সিস্টেম তৈরি হলে কি হবে, মানুষের ভালো হবে না খারাপ হবে, তা নিয়ে গবেষকরা এখনই চিন্তিত।

আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স সিঙ্গুলারিটিঃ সিঙ্গুলারিটি হচ্ছে একটা ম্যাথম্যাটিক্যাল টার্ম। এটা এমন একটা বিন্দু, যেখানে কোন একটা ফাংশনের অবস্থান বা গুণ গুলো নির্ণয় করা সম্ভব হয় না তা বুঝায়। আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্সের ক্ষেত্রে সিঙ্গুলারিটি হচ্ছে ঐ সময় বা বিন্দু, যখন কোন বুদ্ধিমান মেশিন মানুষের বুদ্ধমত্তাকে অতিক্রম করবে। Artificial Super Intelligence প্রোগ্রাম বের হওয়া মানে অলরেডি সিঙ্গুলারিটিতে পোঁছানো।

যদিও উদ্বিগ্ন করার মত কিছু হয় নি এখনো। আমরা এখনো ANI তে পড়ে রয়েছি। যত বুদ্ধিমান মেশিন বা প্রোগ্রাম রয়ছে, সব গুলোই একের অধিক আর্টিফিশিয়াল ন্যারো ইন্টেলিজেন্স এর সমন্বয়ে গঠিত।

আমাদের হাতের স্মার্টফোনটিতে অনেক গুলো ANI প্রোগ্রাম রয়েছে। বর্তমানের সবচেয়ে সফল ANI প্রোগ্রাম হচ্ছে এলেক্সা, সিরি, গুগল এসিস্ট্যান্ট, চ্যাটজিপিটি, মিডজার্নি এসব । চ্যাটজিপিটি এর সাথে চ্যাট অনেকেই করেছি আমরা। আমরা তো ইতিমধ্যে ধারণা পেয়েছি AI কতটুকু উন্নত হয়েছে। গুগলের বা টেসলার সেলফ ড্রাইভিং কার ANI এর সফল প্রয়োগের উদাহরণ। ফেসবুক নিজেও ANI ফ্যাক্টরি বলা যায়। অ্যামাজন বা সব বড় বড় ওয়েব সাইটেই ANI এর ব্যবহার রয়েছে। নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট গুলো পরিচালনা করতে ANI সিস্টেম ব্যবহার করা হয়। যদি একের অধিক ANI প্রোগ্রাম দিয়ে এত সুন্দর সব কাজ করে ফেলা যায়, চিন্তা করা যায় কি হবে তখন যখন আমরা আর্টিফিশিয়াল জেনারেল ইন্টিলিজেন্স বা আর্টিফিশিয়াল সুফার ইন্টিলিজেন্সে পৌঁছাবো?

চতুর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভল্যুশন নিয়ে আসবে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স। ইত্যিমধ্যে আমরা আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্সের অনেক সুবিধে ভোগ করছি। যা আসলে খুবি সামান্য। অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই আরো বড় পরিসরে সব জায়গায় এটির ব্যবহার হবে। তখন হয়তো বাসার কাজের লোকটি হবে একটা রোবট। দোকানের সেলস ম্যান হবে একটা রোবট। বাসায় কোন পার্সেল ডেলিভারি দিয়ে যাবে কোন রোবটে। মুভি নয়, বাস্তবেই এমন হবে। খুব শীগ্রই। যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই ব্যবহার হচ্ছে এমন বুদ্ধিমান মেশিন।

 

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে শিখতে চাইলেঃ

  • Udacity এর Intro to Artificial Intelligence কোর্সটা প্রাথমিক ধারণা নেওয়ার জন্য খুবি দারুণ। সব গুলো ইউনিভার্সিটিতে Artificial Intelligence: A Modern Approach বইটি থেকে পড়ানো হয়। নীলক্ষেত থেকে বইটি কিনতে পাওয়া যাবে। আর বইটির সহ লেখক হচ্ছেন Peter Norvig। পিটার নরভিগ হচ্ছেন গুগলের রিসার্চ টিমের ডিরেক্টর। আর Udacity’র এ কোর্সটার সহ ইন্সট্রাকটর। পিটার নরভিগের একটা দারুণ লেখা রয়েছে। Teach Yourself Programming in Ten Years। যারা পড়েন নি, একবার পড়ে নিতে বলব। এছাড়া এই কোর্সটি করার পর ইউডাসিটিতে আরো কিছু কোর্স রয়েছে, যেমন মেশিন লার্নিং ইত্যাদি। সেগুলোও দেখতে পারেন।
  • edX এর Artificial Intelligence  কোর্সটাও দেখতে পারেন। ব্যাসিক গুলো জানার পর অনলাইনে অনেক রিসোর্স রয়েছে শেখার মত। সাহস করে শুরু করলেই হয়।
  • Stanford এর AI কোর্সের আউটলাইন, স্লাইড গুলো পাওয়া যাবে এখানে। 
  • প্রচুর ধৈর্য্য থাকলে MIT এর তৈরি করা ভিডিও গুলো দেখতে পারেন। এ ছাড়া লেকচার স্লাইড গুলোও ডাউনলোড করে পড়া যাবে।  শেখা শুরু করার জন্য এর থেকে বেশি কিছু আশা করি লাগবে না।

আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স নিয়ে পড়ার পাশা পাশি বিনোদনের জন্য এগুলো দেখতে পারেনঃ

Movies: 

  • Ex Machina (2015)
  • 2001: A Space Odyssey
  • I, Robot
  • Matrix series
  • Chappie
  • Transcendence
  • The Terminator series
  • Star Trek series
  • Tron series
  • Her (2013)
  • A.I. Artificial Intelligence ইত্যাদি।

TV series:

  • Person of Interest
  • Human
  • Intelligence
  • Mr Robot ইত্যাদি।

13 thoughts on “আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে ধারণা এবং আমাদের অবস্থান”

  1. এন্ড্রয়েড এসিস্টেন্ট HOUND দেখি সিরি, কর্টানা, গুগল থেকেও ভাল ভয়েস রিকগ্নেশন করতে পারে। 😀

    Reply
  2. computer jdi second level e pouche jay won’t it already be at 3d stage? I mean we can learn ourselves to but we have some limitations which computer doesn’t .So if the computer reaches our level it’ll definitely be smarter than us, right?

    Reply

Leave a Reply