ন্যাশনাল হ্যাকাথন এবং আমি …

ছয় এবং সাত তারিখ ছিল ন্যাশনাল হ্যাকাথন। যে কোন প্রতিযোগিতাই আমি একটু আধটু এড়িয়ে চলি। কারণ প্রতিযোগিতা করে আমি কোন দিন ও ভালো কিছু করতে পারি নি। জিততে চাই সব সময়, হেরে গেলে কত খারাপই না লাগে। সব সময়ই হেরেছি, তাই এখন আর সাহস হয় না কোন প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করতে।

আচ্ছা, ন্যাশনাল হ্যাকাথন সম্পর্কে একটু বলে নি। আমাদের জাতীয় ১০ টি সমস্যা দেওয়া হয়েছিল। যে গুলো স্মার্ট ফোন অ্যাপ ব্যবহার করে কিভাবে সমাধান করা যায়, তা বের করতে হবে। দুই দিনে ৩৬ ঘণ্টা এক টানা অনুষ্ঠানে বসে কাজ করতে হবে।  এক টীমে ৫ জন মেম্বার করে ছিল। প্রায় ১৫০০+ জন এখানে প্রতিযোগী হিসেবে জয়েন করেছে।

৬ তারিখ এবং ৭ তারিখে এই ন্যাশনাল হ্যাকাথন অনুষ্ঠিত হয়েছে Institution of Diploma Engineers, Bangladesh (IDEB) ভবনে। ৫ তারিখে রাতে ঘুমাই নি। ওই দিন রাতে পার্থ সারথি কর ভাই জিজ্ঞেস করেছিল যাবো কিনা হ্যাকাথনে। আমি বলছি গেলে দেখা হবে। আমার যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। উনি এর আগের দিন বলেছিল BUET এ ACM ICPC তে গিয়ে দেখা করতে। আমি তাও দেখা করি নি। সিলেট থেকে এসেছেন পার্থদা। উনার ছাত্রদের নিয়ে, ICPC তে অংশ গ্রহণ করতে। উনি বলল ৯টার দিকে থাকবে হ্যাকাথনে।  আমি সারা রাত জেগে ঘুমাতে যাই সকালের দিকে। তাই চিন্তা করলাম সকালে না ঘুমিয়ে আগে উনার সাথে দেখা করি,  তা ছাড়া Houer of Code এর প্রেস কনফারেন্সেও যেতে হবে। পরে এসে ঘুমাবো।

ফজর নামাজ পড়ার সময় রেডি হয়ে গেলাম। একবারে বের হবো, রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করব। নাস্তা করব, এবং শেষে হ্যাকাথনের ঐখানে গিয়ে দেখা… ফজরের নামাজ বাসাবো মসজিদে পড়ে হাঁটা হাঁটি শুরু করলাম। খিলগাঁও ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে উঠে আস্তে আস্তে IDEB ভবন এর দিকে গেলাম। কিছুক্ষণ পর দেখি আমি IDEB এর সামনে। শোভন ভাই আমাকে  ডাকছে। আমি আসলে IDEB চিনতাম না। শোভন ভাই আমাকে ডাকার কারণে ভালো হয়েছিল, না হয় আমি হেঁটে হেঁটে আমি অনেক দূর চলে যেতাম। শোভন ভাই এসেছিল সিলেট থেকে, হ্যাকাথনে। তখনো  ৭টা বাজে। এন্ট্রি শুরু হবে ৮টায়। ঐখানে দাঁড়িয়ে তাই সবার সাথে কথা বলতেছিলাম। অনেকেই অনেক দূর থেকে এসে আস্তে আস্তে জড়ো হতে লাগল।

নাস্তা করি নি তখনো, তাই ভাবলাম নাস্তা করে নিব। নাস্তা করে ফিরে আবার IDEB এর সামনে আসলাম। আরো অনেকের সাথেই দেখা হলো। কথা হলো। অনলাইনে একটু আধটু লেখা লিখি করার কারণে দুই এক জন চিনতে পারে। কথা বলতে আসে, ভালো লাগে।

যাই হোক, আমি হ্যাকাথনে গিয়েছি দেখতে। অবজারভার হিসেবে। সবাই জিজ্ঞেস করছিল, ভাই কি পার্টিসিপেট করছেন? আপনার টীম কই? আমি  বলি, আমি পার্টিসিপেট ও না, মেন্টর ও না। অবজারভার।

কিছুক্ষণ পর হাসিন ভাই এর সাথে দেখা। বসে কথা বললাম। বললাম দেখতে এসেছি। উনি বলে মেন্টর হিসেবে যোগ দি না কেনো? মজা হবে। উনি বলাতে মেন্টর হিসেবে যোগ দিলাম। এরপর উনাদের সাথে এক সাথে নাস্তা খেতে রেস্টুরেন্টে গেলাম। খাওয়া দাওয়া করে ফিরে মেন্টরদের কি কি করতে হবে, তা জানলাম। কিভাবে স্কোরিং করতে হবে তা জানলাম। মেন্টর দের টীম তৈরি করা হলো। একটিমে দুই জন বা তিন জন। আমার টীমে ছিল দুই জন, আমি আর রমি ভাই। অবজারভার থেকে মেন্টর হয়ে গেলাম। যদিও মেন্টর ও এক ধরনের অবজারভার।

আগের দিন রাত না ঘুমালেও এক্সাইটমেন্ট এর কারণে ঘুম পালিয়ে গিয়েছিল। এদিক ঐ দিক দেখা শুনা করলাম। এরপর এক সময় স্কোরিং এর কাজ। স্কোরিং কাজ আমার জন্য ভয়াবহ কঠিন একটা কাজ। কারণ অনেক কিছু চিন্তা করতে হয়। সব সময়ই ভয় হয় আমি কি সঠিক মূল্যায়ন করতে পেরেছি? ভয়ে ভয়ে প্রথম দিনের স্কোরিং শেষ করলাম। আমারা মোট ১৮টা টিমকে স্কোরিং করেছি। প্রায় ২০০ টিম এর মত ছিল। প্রথম দিনে স্কোরিং করা হয়েছিল ৬০ এর। যা আইডিয়া, ইনোভেশন এবং প্রজেক্ট ডিজাইন এর উপর ছিল।
স্কোরিং করে সব কিছু জমা দিয়ে যখন আমাদের কাজ শেষ হলো, তখন বাসায় ফিরে আসলাম। বাসায় এসে ঘুম…

পরের দিন সকালে মানে ৭ তারিখে ৯টার দিকে আবার গেলাম। আজ কোডিং এর উপর স্কোরিং এর কাজ ছিল। আইডিয়া এবং ইনোভেশনে টীমরা যত সুন্দ করতে পেরেছে, কোডিং এ এসে তত খারাপ করেছে। আমরা একটি টিমকে আইডিয়া এবং ইনোভেশনের জন্য সর্বোচ্চ নাম্বার দিয়েছি, পরে কোডিং এ এসে তারা ঠিক মত কিছুই দেখাতে পারে নি… কারো কোড রান হচ্ছিল না, কারো কম্পিউটারে সমস্যা ইত্যাদি ইত্যাদি। অনেকে আবার অনেক ভালো করেছে।  যাই হোক যে কাজ তারা ৩৬ ঘণ্টা ওরা চেষ্টা করেছে, তা করতে স্বাভাবিক ভাবে ৩৬ দিন লাগার কথা। ওদের চেষ্টা, ডেডিকেশন সব ছিল দেখার মত। কোডিং পার্টের স্কোর ছিল ৪০ নাম্বার।

এত বড় অনুষ্ঠানের খারাপ দিক হলো খাবার… খাবারের প্রতি খুবি সেনসেটিভ , তাই একটু এদিক ঐদিক হলেই আর খেতে ইচ্ছে করে না।

প্রোগ্রামটা খুব সুন্দর ভাবেই শেষ হয়েছে। কোন রকম ঝামেলা চোখে পড়ে নি। অরগানাইজার, ভলেন্টিয়ার সবাই সুন্দর ভাবে সব দেখা শুনা করেছে। শেষ মুহুর্তের আনন্দ সব সময়ই মনে থাকবে। সবাই এত্ত উৎচ্ছাস করেছে, সত্যিই দেখার মত ছিল।

যারা এই হ্যাকাথনে ভালো করতে পেরেছেন, তাদের অভিনন্দন।

অনেকেই অনেক চেষ্টা করেছেন। সবারই আশা ছিল ভালো করা। পুরষ্কার যেতা। সবাই তো আর পুরষ্কার পেতে পারে না, তাহলে তো প্রোতিযোগিতার আয়োজন করে আর কোন লাভ হতো না… যেহেতু সমস্যা গুলো আগেই সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল, অনেক টীম আগে থেকেই সমস্যা গুলোর সমাধান করে ফেলেছে। এবং পরে হ্যাকাথনে এসে শুধু প্রেজেন্ট করেছে। আর এ কারণে এমন যারা করেছে, তারা অন্যদের থেকে এগিয়েছিল এবং তারা প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্থান অর্জন করেছে।

ভালো করে চেষ্টা করে এবং ভালো কিছু করেও যারা প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্থান অর্জন করতে পারেন নি, তাদের আরেকটি কারণ রয়েছে আপনি যে সমস্যা নিয়ে কাজ করেছেন, তা নিয়ে অনেকেই কাজ করেছে। সমস্যা ছিল মোট ১০টি। এ ১০ টির প্রতিটি থেকে তিনটি টীম সিলেক্ট করা হয়েছে। প্রথম দ্বিতীয় এবং তৃতীয়। এভাবে ১০ টি সমস্যা থেকে মোট ৩০ টি।

এখন আপনার টিম এমন একটি সমস্যা নিয়ে কাজ করেছিল, যে সমস্যা নিয়ে অনেক টিম কাজ করেছিল, কমন সমস্যা, ঐসমস্যাতে ভালো করার প্রভাবিলিটি তাই কমে গেছে। আবার কিছু কিছু সমস্যা ছিল যে সমস্যা নিয়ে অল্প কয়েকটি টীম কাজ করেছিল, আর ঐ অল্প কয়েকটা টিমের মধ্যে থেকে আপনার থেকে খারাপ প্রজেক্ট করার পর ও প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্থান অর্জন করতে পেরেছে…  তাই খারাপ করায় মন খারাপ করার কিছুই নেই। এমন না যে আপনার প্রজেক্ট হয় নি, আপনি খারাপ করেছেন।  🙂

পুরো হ্যাকাথনটি ছিল একটা উৎসাহ এর মত। একটা ঈদ ঈদ ভাব, ডেভেলপার দের জন্য।  এত গুলো ডেভেলপার এক সাথে কাজ করা, দিন রাত ৩৬ ঘণ্টা না ঘুমিয়ে কাজ করা, অবিশ্বাস্য রকমের ভালো লাগা কাজ করছিল আমার কাছে।

আমি হচ্ছি ফেল করার দলে। খারাপ করে বসে থাকার দলে নই। চেষ্টা করে যাওয়ার দলে। এক দিন খারাপ হয়েছে তো আরেকদিন ভালো হবে, এই আশাতে বিশ্বাসী। যাদের ফলাফল আশানুরূপ হয় নি, বসে না থেকে আরো ভালো করে কাজ করে যাওয়া উচিত। দুইটা গান শুনতে ইচ্ছে করছে এখন, একটা বাংলা, একটা ইংরেজিঃ

  1. যদি লক্ষ্য থাকে অটুট বিশ্বাস হৃদয়ে, হবেই হবে দেখা, দেখা হবে বিজয়ে। : https://www.youtube.com/watch?v=Z2K6ShgbP8I
  2. Nico & Vinz – Am I Wrong : https://www.youtube.com/watch?v=VBmEJZofz2s

আরেকটা গান ও এখন ভালো লাগবেঃ K’NAAN – Wavin’ Flag : https://www.youtube.com/watch?v=WTJSt4wP2ME

সামনে ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের হ্যাকাথন রয়েছে… এমন অনুষ্ঠান আশা করি বাংলাদেশে আরো বেশি করে হবে। যারা এমন ভবিষ্যতে অনুষ্ঠিত হ্যাকাথন গুলতে অংশ গ্রহণ করবেন, তাদের জন্য অগ্রিম শুভেচ্ছা, হ্যাপি হ্যাকিং 🙂

4 thoughts on “ন্যাশনাল হ্যাকাথন এবং আমি …”

  1. মোবাইল দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে পড়লাম। ভালো লাগলো আর আমিও হতে চাই একজন এপ্স ডেভেলপার। দোয়া রাখবেন

    Reply

Leave a Reply